
সেই যে দিনগুলি
বাঁশী বাজানোর দিনগুলি
ভাটিয়ালীর দিনগুলি
বাউলের দিনগুলি
আজও তারা পিছু ডাকে
কূলভাঙা গাঙের বাঁকে
তালসুপারির ফাঁকে ফাঁকে
পিছু ডাকে পিছু ডাকে :
শুনি তাক্দুম তাক্দুম বাজে, বাজে
ভাঙা ঢোল!

ভাটিয়ালির দিনগুলি ভাবতে গেলে আজ বহু পেছনে তাকাতে হয়, কোথায় বুঝি ভেঙ্গে গেছে সাঁকো, কেউ নিরন্তর বাজিয়ে যাচ্ছে ভাঙ্গা ঢোল। মোহিনী চৌধুরীর রচনা এবং শচীন দেব বর্মণের গায়কীতে ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়া এই গানে অন্তর্লীণ হাহাকারকে ছুঁয়ে ভাটিয়ালীর ভুবনে দৃষ্টি ফিরালাম। অবশ্য হরেকরকমের আধুনিকতা আর উন্নয়নের ডামাডোলে সেই বিচ্ছেদি আওয়াজ এখন আর সুতীব্র নয়। এই আপাত নেতিবাচক, হাহাকারের আবহ মেখে আলাপ শুরু করছি মূলত ভাটিয়ালী গানের সাম্প্রতিক চর্চার হালহকিকত বুঝে নেয়ার জন্য। শুরুতেই দৃশ্যত আক্ষেপ আর তর্কের রূঢ় কোন স্বরে আটকে গেলাম হয়তোবা তবে এ রূঢ়বচনের কথার সূত্রপাত বহু আগেই করেছিলেন কিংবদন্তী সংগীতকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর “লোকসংগীত সমীক্ষাঃ বাংলা ও আসাম” গ্রন্থে পরবর্তীতে যা ‘গানের বাহিরানা’ নামক সংকলনে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। সেখানে তিনি লোকসংগীতের সংকটের প্রধান তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছিলেন, প্রথমত -কলকাতা (আজকের ঢাকাও পড়া যেতে পারে) মহানগরীর সাংস্কৃতিক চরিত্র, দ্বিতীয়ত- কলকাতার পরিপার্শ্বস্থ লোকসংগীতে নিষ্ফলা অঞ্চল, তৃতীয়ত- বঙ্গভঙ্গ। তাঁর ‘লোকসংগীতের একাল না আকাল?’ শীর্ষক প্রবন্ধে আলোচিত জিজ্ঞাসাসমূহ এই সুদীর্ঘ সময়ে একাডেমিক পরিসরে মীমাংসা করার উদ্যোগ চোখে পড়েনি অর্থাৎ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের শংকা আমলে নেয়া হয়নি। একই রকম আক্ষেপ তারও ঢের আগে ও পরে বহুমাত্রিকভাবে উত্থাপন করেছেন হারামণির সংগ্রাহক মনসুরউদ্দিন, ’বঙ্গীয় লোকসংগীত রত্নাকর’ ও ‘বাংলা লোকসাহিত্য’ গ্রন্থের রচয়িতা, গবেষক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যসহ আরও অনেকেই। সাম্প্রতিককালে ডয়েচে ভেলে’তে প্রকাশিত খ্যাতিমান লোকসংগীত শিল্পী ও সংগ্রাহক মুস্তাফা জামান আব্বাসীর লেখায়ও সেই একই আক্ষেপের প্রতিধ্বিনি-
“ভাটিয়ালি মরে যাচ্ছে৷ কারণ, নদী মরে যাচ্ছে৷ নদীর উজানে বাঁধ বেধেছে বন্ধুরা৷ আর ভাটির দিকে সব নদী খেয়ে ফেলেছে লুটেরা সম্প্রদায়৷ নদী বন্ধ করে শহর, বন কেটে বসত৷ এই তো বাংলাদেশ৷ … কোথায় আব্বাসউদ্দিন, কোথায় জসীমউদ্দিন, কোথায় মমতাজ আলি খান, কোথায় কানাইলাল, কোথায় বিজয়? নতুন লেখকরা ঘাবড়ে গিয়ে নতুন নতুন ভাটিয়ালি লিখছেন, যাতে না আছে সুর, না আছে ছন্দ, না আছে ভাটিয়ালির রস৷ নদী নেই, নৌকো নেই, তা হলে ভাটিয়ালি থাকবে কী করে?’’
এই আর্তনাদ, শংকাবাণী বা রূঢ়বচন কার্যত আমাদের নাগরিক বুদ্ধিজীবি মহলে কার্যকরী আলোড়ন তুলতে পারেনি বলাই বাহুল্য, সুদীর্ঘ সময় ধরে কোন ধারাবাহিক পাঠ, মাঠসমীক্ষা, গবেষণার দৃশ্যমান নজিরও নেই বলা চলে। সমূহ উদযাপন মোটামুটিভাবে রাজধানীতে এসে একক চেহারায় লীন হয়ে গেছে আর সামাজিক, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষতকার বদলে কর্পোরেটমূখীনতা, বাজার সংস্কৃতির পুষ্টিবর্ধনে নিয়োজিত হয়েছে অবধারিতবাবেই। ফলত উল্লিখিত বিদ্বৎজনের শংকা ক্রমশ রুঢ় বাস্তবতায় পর্যবসিত হয়ে এক জটিল সময়েরে মুখোমুখি করে দিয়েছে আমাদের। নাগরিক প্রহরে আজ হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শচীন দেব বর্মণ, অমর পাল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, উৎপলেন্দু চৌধুরী প্রায় বিস্মৃত নাম, ওপার বাংলার(!) শিল্পী! আব্বাসউদ্দীন, আব্দুল আলীমও কি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপিত হন? অথচ বর্ষবরণ, লোকজ উৎসবের উপলক্ষের প্রেরণায় আয়োজিত অনুষ্ঠানমালা, রিয়েলিটি শো এর উঠান কিংবা টিভি প্রোগ্রামে হঠাৎ আলোর ঝলকানি লাগে! এ বিস্মরণ, এ উল্লম্ফন, সংকরায়ন উৎসবে কতটুকু পুষ্টি পায় বাংলা গান, বাংলার গান? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রহরে বরং প্রশ্নগুলো গুছিয়ে নেয়া যাক।
এই আলাপে ভাটিয়ালী’র বিবর্তনের কতিপয় চিহ্ন সাম্প্রতিকতার আলোকে পাঠের চেষ্টা করব এবং সংগতভাবেই তা ভাটিয়ালীর ভুবন পেরিয়ে লোকসংস্কৃতির বিস্তৃত ভুগোলেও সম্প্রসারিত হবে কেননা ভাটিয়ালী চর্চার সাম্প্রতিক অবস্থা একবারেই স্বতন্ত্র কোন বিষয় নয় বরং লোকসংস্কৃতি, লোকায়ত জ্ঞান চর্চার সার্বিক দুরবস্থারই অংশীদার। মুস্তাফা জামান আব্বাসী, তাঁর ’ভাটির দ্যাশে ভাটিয়ালী’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন যে ১১৪ রকমের গান আজ বিলুপ্ত। পরিসংখ্যানগত শুদ্ধতা বিবেচনার বাইরে রেখেও নিশ্চিত করে বলা যায় যে অঞ্চলভেদে শতরকমের লোকজ সংস্কুতির উপাদান বিলুপ্ত হয়েছে, অনেকগুলোই আজ বিপন্ন প্রায়। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশেরে সাস্কৃতিক সমীক্ষামালা-১০: লোকসংগীত’ অনুরূপ সাক্ষ্য দেয়। এই সমীক্ষা অনুসারে ভাটিয়ালী, সারিগান কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল হতে বিলুপ্তপ্রায়। এ বিলুপ্তি রোধে রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিকভ্যাবে ব্যাপকতর কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এ আলাপের সূত্রপাঠে ভাটিয়ালী চর্চার সাম্প্রতিক ধরণটিকে বিবেচনায় রেখে তা বুঝে নিতে চাওয়া এ প্রক্রিয়ায় প্রধান বিগত শতকের যেসকল পথিকৃত শিল্পী এবং সঙ্গীতকার সাফল্য ও উৎকর্ষতার চুড়ায় আসীন হয়ে দৃশ্যত বাংলা গান তথা ভাটিয়ালীর গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভুমিকা পালন করেছেন তাঁদের শিল্পকৃতির নির্বাচিত উপাদানের নিবিড় পাঠ হাজির করতে সচেষ্ট থাকব।
এই সুরের দৌলতে আমি জগৎ করলাম জয়
… তবু নিদহারা নগরের পথে রাইতের দুপুরে
মরমিয়া ভাটিয়ালী আমার গলায় ঝরে ।
এইনা সুরের পালের দোলায় খুশির হাওয়া বয়
এই সুরের দৌলতে আমি জগৎ করলাম জয় ।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২ – ১৯৮৭) যে সুরের দৌলতে জগৎ মাৎ করেছেন তার নাম ভাটিয়ালী। সুরে, রঙে এই গানের ভুগোল বিচিত্র ভাব ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। ভাটিয়ালীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ বা গুণবিচারী এ লেখার উদ্দেশ্যে না হলেও নাগরিক বুদ্ধিজীবি মহলে এমনকি সংগীতবোদ্ধামহলেও ভাটিয়ালী আলাপে গরহাজির থাকাটা পীড়া দেয় বলে, আলাপের সূত্র ধরিয়ে দেবার উছিলায় ভাটিয়ালীর পরিচিতমূলক আলাপটুকুও তোলা যাক। বলাই বাহুল্য, সংগীত বিষয়ক লেখালেখি খুব একটা সুলভ নয় এবং উপলক্ষের হাওয়ায় যা কিছু রচিত হয়েছে তার অধিকাংশই মূলত গতানুগতিক পাঠ এবং সাধারণ বর্ণনামূলক, সমাজ রূপান্তর, সময়ের পালাবদলের চিহ্নপাঠের প্রয়াস সেখারে প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে। তাছাড়া ঔপনিবেশিক দাসানুবৃত্তিক মানসকিতার নিগড়ে আটকা পড়া তথাকথিত শিক্ষিত, এলিট বর্গের কাছে লোকসংগীত (এ নামকরণও প্রশ্নে উর্ধ্বে নয়, গবেষক কামালউদ্দন কবির তাঁর মাঠ গবেষণার ফলাফলে প্রস্তাব করেছেন ‘গীতরঙ্গ’ নামটি। ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতকা প্রভৃতি নামকরণও মূলত নগরেরই চাপিয়ে দেয়া) তো প্রান্তের ব্রাত্যসংগীত প্রায়। মতাকাঠামোর সাথে সম্পর্ক বিবেচনায় লোকসংগীত এমন দারুণ অনাদরের জমিনে অল্পবিস্তর গবেষণামূলক বইসমূহ অধিকাংশই রচিত হয়েছে ব্যাক্তি উদ্যোগে (ক্ষেত্রবিশেষে ডিগ্রিপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে) এবং তার অধিকাংশই সহজে সুলভ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক এবং একাডেমিক মহলের এই ঔদাসীন্যের ঐতিহ্য ক্রমশ বুঝি সুদৃঢ় হচ্ছে। ফলে নগরে আধিপত্যকামী বুদ্ধিজীবিতার ছায়ায় নির্মিত হচ্ছে মৃত্তিকালগ্ন জীবনের খন্ডিত, আরোপিত, কল্পিত পাঠ এবং ক্রমশ যা বিবর্তিত ও বিকৃতির খেয়ায় শিকড়ছেঁড়া এক সংকর রূপ লাভ করে, কখনো বিলুপ্ত হয় অলক্ষ্যে। নগরের কোলাহলে এই বিস্মরণ বোঝা দুষ্কর যদি না সংবেদনশীল পাঠক এর প্রতি যত্নশীল হল, মনযোগী হন এবং এর প্রসার ও সংরক্ষণে আগ্রহী হন। এই লেখাটি সেই সংবেদী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবে ।
ভাটিয়ালী’র সংজ্ঞা কী হবে এ নিয়েও বিস্তর আলাপ হয়েছে তা বলা যাবে না। প্রচলিত সংজ্ঞাগুলো মোটামুটিভাবে একত্র করেছেন ওয়াকিল আহমদ তাঁর ‘বাংলা লোকসংগীত : ভাটিয়ালী গান’ গ্রন্থে। বাহুল্য বর্জনের উদ্দেশ্যে সবকটি উল্লেখ করা হল না। বাংলাপিডিয়া অনুসারে – ”ভাটিয়ালি এক ধারার লোকগীতি। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য সুরের দীর্ঘ টান ও লয়। প্রচলিত মতে মাঝিমাল্লাদের গান থেকে ভাটিয়ালি সুরের উৎপত্তি। নিকট অতীতে নদীবিধৌত বাংলাদেশে সাধারণত নদীর ভাটির স্রোতে নৌকা বাইতে মাঝিদের তেমন বেগ পেতে হতো না। তাই সেই অবসর ও আনন্দে তারা লম্বা টানে গলা ছেড়ে গান গাইত। কালক্রমে এই গানই ভাটিয়ালি গান নামে পরিচিতি লাভ করে।’’ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলায় এই গান বিশেষভাবে প্রচলিত।” ওয়াকিল আহমদ, আশরাফ সিদ্দিকী, নির্মলেন্দু ভৌমিক এর সংজ্ঞায়ন এবং প্রচলিত ধারণা মোতাবেক ভাটিয়ালি মূলত নদী-নৌকা-মাঝিকেন্দ্রিক গান। অনেকেই সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন ভাটির গান, ভাটি অঞ্চলের গান। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য’র মতে ’’ভাটিয়ালী কেবল মাঝির গান নহে , ইহা গো কিংবা মহিষরক্ষক, রাখাল বা মহিষালদের এবং বাউল বৈরাগীরও গান” (বাংলার লোকসাহিত্য) । অবশ্য খেয়াল রাখা জরুরী যে কীর্তন, বাউল, মুর্শিদী-মারফতি, বিচ্ছেদী ইত্যাদি গানে ভাটিয়ালী সুরের অবাধ প্রভাব ভাটিয়ালীর পরবর্তী সম্প্রসারণ পর্বের কথা। বিস্তৃত প্রান্তর, উদার আকাশ আর কর্মহীন সময় মাঝি, রাখাল, কৃষককে অবসর উদযাপনের যে প্রেরণা দেয়, শ্রোতাহীন, সংগীহীন সময়ে যে অবাধ সুরের খেয়ায় আপনার অন্তর্গত অনুভুতি প্রকাশের অনিন্দ্য শব্দকল্প করে রচনা। ভৌগলিক পরিবেশের প্রভাবে এই সুসংহত সংগীত সৃষ্ট হওয়াকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘বাহিরানা’ হিসেবে যা মূলত ’আঞ্চলিকতা’। লোকগানের এ এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ বিচারেই ভাটিয়ালী পূর্ববঙ্গের মানে বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব সংগীত। ভাটিয়ালী একক গান, তাল বাদ্যহীন। নাগরিক পাটাতনে এসে নানারকম যন্ত্রের যন্ত্রনাদীর্ণ, নানারকম আরোপিত অলংকারে পরিবেশিত ভাটিয়ালী তার আপন স্বকীয়তা হতে কতটা বিচ্ছিন্ন, বিকৃত তার দিকে সমঝদারি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস (গানের বাহিরানা দ্রষ্টব্য) এবং সমরূপ কথার প্রতিধ্বনি ধ্বনিত হয়েছে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য প্রণীত ‘বংগীয় লোকসঙ্গীত রত্নাকর’ প্রন্থে।
’’বর্তমানে এক শ্রেণীর ‘সহুরে’ ভাটিয়ালীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় স্থাপিত হইয়াছে। তাহার প্রধান বিশেষত্ব এই যে, নানা বাদ্য-যন্ত্র সহযোগে তাহা গীত হয়; সুতরাং পল্লীর ভাটিয়ালীর প্রদান বৈশিষ্ট্যই ইহাতে রক্ষিত হয় না” । ইহার আর একটি বিশেষত্ব এই যে, অনেক সময় পল্লীর ভাটিয়ালীর নিজস্ব ভাষা পরবির্তিত করিয়া ইহা সহরের রুচি অনুযায়ী সূতন করিয়া রচিত হইয়া থাকে। এইভাবে পল্লীর ভাটিয়ালীতে যাহা দেহতত্ত্ব বিষয়ক বলিয়া পরিচিত, তাহাই সহরে আসিয়া সাধারণ প্রেমসঙ্গীত হইয়া দাঁড়ায় (পৃ- ১৫৯৯)।
নগরের এই আধিপত্যকামী প্রবণতা শুধু ভাটিয়ালী নয় বরং সামগ্রিকভাবে লোকসংগীতের প্রায় সকল ধারার জন্য প্রায় সমভাবে প্রযোজ্য, ভাটিয়ালী একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত মাত্র। স্মর্তব্য গ্রামাফোন রেকর্ড এর যুগ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ‘আধুনিক গান’ তকমাটি সদম্ভে মূলধারা(!) হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু করে এবং বাজার সংস্কৃতির হাত ধরে লোকসংগীতের সর্বনাশের শুরু এই সময়েই। করুণাময় গোস্বামী তাঁর ‘বাঙালির গান’ শীর্ষক গ্রন্থে আমাদের দেশের বর্তমান কালের প্রচলিত সংগীত রীতিসমূহে তিনটি শ্রেণীভুক্ত করেছেন; লোকসংগীত, নাগরিক সংগীত এবং দরবারি সঙ্গীত। তিাঁর মতে ‘বাংলার নগরসমূহে বিকাশপ্রাপ্ত সঙ্গীতকে বলা হয় নাগরিক সঙ্গীত।’ অন্যত্র লিখেছেন, ‘নাগরিক গানই বাঙালির প্রধান গান। এটিকেই বলবো মূলধারা’ (বাঙালির গান,পৃ-৮০)। বলাই বাহুল্য, এই নাগরিক গানই তথাকথিত ’আধুনিক গান”। তার মানে দাঁড়ায় অনাধুনিক, অপ্রধান, প্রান্তীয় আরেকটি ধারা আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা অঞ্চলের লোকগান বিষয়ক গ্রন্থের প্রণেতা, গবেষক হীরামন পোদ্দার সচেতনভাবেই বুঝি তাঁর বইয়ের নামকরণ করেছেন ‘প্রান্তবঙ্গের ব্রাত্য-সংগীত’। অথচ দুয়ের মধ্যে কোন বিরোধ থাকবার কথা নয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ব্যাখানুসারে জাতীয় সংষ্কৃতির প্রধান দুটি ধারা, কেন্দ্রাতিগ লোকসংগীত আর কেন্দ্রানুগ উচ্চাংসংগীত এক অপরের পরিপূরক রূপেই আদৃত হওয়ার দাবী রাখে (গানের বাহিরানা)।
নগরের অধিপতিদের নিকট লোকসংগীত সততই ব্রাত্য ছিল, সেটা এই বঙ্গদেশ হোক আর ইউরোপ যেখানেই হোক না কেন। হোমাঙ্গ বিশ্বাস গানের বাহিরানা’য় এ প্রসঙ্গে বিস্তৃত তথ্য উপাত্তসহ আলোচনা করেছেন। উনবিংশ শতকে Folk Music কোনো স্বীকৃতি পায়নি। ইউরোপের সেসময়কার ধ্রুপদী সংগীতে দিকপালগণ লোকসংগীত থেকে রসদ আহরণ করলেও লোকসংগীত স্বকীয় মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৮৬৪ সালে উইলিয়াম জন টমস্ Folklore শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন, ১৮৭৮ সালে ইংল্যান্ডে Folklore Society গঠিত হয়। ১৮৪৮ সালে মার্কস ও এঙ্গেলস লিখলেন Communist Manifesto. ইউরোপে শ্রমজীবি মানুষের গণজাগরণ সামন্তীয় শাসন কাঠামোর ভিত কাঁপিয়ে দেয়, গণমানুষের সংঘবদ্ধ শ্রেণীচেতনা, তাদের নিত্যকার উদযাপনে দ্রোহী, নিজস্ব সুর ও স্বর শাসকশ্রেণীতো বটেই শিক্ষিত নাগরিক বৃদ্ধিজীবিদের চেতনাকেও চরমভাবে আঘাত করে। ফলত এই প্রান্তেবর্গের স্বর ব্রাত্য গোত্রভুক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। উনিশ শতকের ইউরোপ কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশ, ক্ষমতা কাঠামোর প্রশ্নে তথাকথিত এলিটবর্গ এবং তাদের দাসানুদাস বাজারকাঠামো ও এর পুঁজিপতিগণ সমধর্মী আচরণ করবেন তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তো সমাজতন্ত্রী সংগীততাত্ত্বিক সেসিল শার্প এর হাত ধরে বিশ শতকের প্রথম দশকেই লোকসংগীত ইংল্যান্ডের সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হল। ১৯৫৪ সালে তাঁরই প্রস্তাবিত Continuity – Variation- Selection এই তিন মূলনীতিকে ভিত্তি বিবেচনা করে বাংলা লোকসঙ্গীতের সংকটের সমাধান খুঁজেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস।
এই দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে
নিজেদের ঘরে ফিরে বরং নগর, রাজধানী, ইন্ডাস্ট্রি, মিডিয়া’র এই আধিপত্যকামীতার শুরুর দিকের নজির পাঠ করা যাক। করুণাময় গোস্বামী নাগরিক গানকে মূলধারার গান স্বীকৃতি দিলেও লোকসংগীতের বিকৃতি বিষয়ে সরব থেকেছেন এবং টেলিভিশন, রেডিওর হাত ধরে এই বিকৃতির চরিত্রও উন্মোচন করেছেন। কিন্তু এই আক্ষেপের মধ্য দিয়েও ’নাগরিক গান’ প্রায় নির্রোধভাবেই ’আধুনিক গান’ হয়ে তথাকথিত মূলধারা হয়ে ওঠার অনুমোদন পেয়ে যায়, ফলে আধুনিক বনাম গ্রাম্য, নাগরিক বনাম লোক গান, মূলধারা বনাম প্রান্তিক, প্রমিত বনাম অপ্রমিত, শ্লীল বনাম অশ্লীল বাইনারিসমূহ বাজার পেয়ে যায়। এই নীরব অনুমোদন, আপসকামিতার ইতিহাস পাঠ করতে গেলে দারুণ বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। যাঁদের হাত ধরে লোকসংগীত উচ্চাসনে আসীন তাঁদেরও নানানরকম আপকামিতা, নীরবতা আর পরোক্ষ অনুমোদনেই যে এই দুরবস্থার সূচনা হয়েছে, ভক্তির আসন সরিয়ে নিরেপক্ষে পাঠ হাজির করতে গেলে দৈন্য অনুভব হয়। বলে রাখি কিংবদন্তীতুল্য এইসব মহান সংগীতকারদের চরিত্রহনন বা মহিমা ক্ষুন্ন করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয় বরং বিচ্যুতি, বিভ্রান্তির চিহ্নসমূহ সূত্রবদ্ধ করে এর পরম্পরা পাঠ এবং নতুন প্রস্তাবনা তৈরির নিরিখেই এই ব্যবচ্ছেদ। সমালোচনা শব্দটি এতটাই নেতিবাচক নিয়ে জারি আছে যে কেজো আলাপটিও হয়তোবা সেলফ সেন্সরনিশপে পড়ে কেঁচে যায় প্রায়শই।
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য (১৯৭০ – ২০১৭) , হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাথে সুর মিলিয়ে দারুণ ক্ষোভের সাথে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন খ্যাতিমান লোকসঙ্গীতশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীকে (১৯২২-১৯৮১)। বাংলাদেশের এখনকার তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি হয়তো অচেনা প্রায় কিন্তু ‘সোহাগ চাঁদ বদনি’ গানটির শিল্পী বললেই কারো চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তো ’সোহাগ চাঁদ বদনি’ গানটি সিলেট অঞ্চলের বৌ নাচের গান। গানটির একটি অন্তরার কথা এরকম-
নাচইন ভালা সুন্দরী-এ
পিন্দইন ভালা নেত
হেলিয়া দুলিয়া পড়ে
সুন্দি জালির বেত।
নির্মলেন্দু চৌধুরী লিরিক পাল্টে ’পিন্দইন ভালা নেত ‘ এর বদলে গাইলেন ‘বাঁধেন ভালো চুল’, ’সুন্দি জালির বেত’ এর জায়গায় গাইলেন ’নাগ কেশরের ফুল’। বৌ নাচের গানের দৃশ্যকল্প গেল পাল্টে, জালি বেতের মত হেলে দুলে ওঠা দেহের চিত্রকল্প পাল্টে অদ্ভুত গোঁজামিল হয়ে নাগকেশরের ফুল ঝরে পড়ল! গানটি তার স্থানিক সংযোগ, জনপদের আচার অনুষ্ঠানের গল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধুই একটি নাচের গান হয়ে গেল! কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের চরম আক্ষেপ এই কারণে যে নির্মলেন্দু চৌধুরী সিলেট অঞ্চলেরই মানুষ, সেখানকার জল হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন, বৌ নাচের গানের কথা ও অন্তরের সুরটি জানতেন নিশ্চিভাবেই, কিন্তু নগরের আসর মাত করবার প্রয়াসে একট ভদ্র করে নেয়া, গানটিকে জাতে তুলে(!) পুঁজিপতিদের পাতে তুলে দিতে কুন্ঠাবোধ করলেন না! এই পালিশ করে নেয়ার প্রক্রিয়াটা মোটামুটি সাধারণ নিয়ম ছিল। বাংলা গানের আরেক কিংবদন্তী শচীন দেব বর্মণকেও (১৯০৬ – ১৯৭৫) এরূপ আপোষ করতে হয়েছিল ক্যাসেট কোম্পানির মন যোগাতে। ১৯৩২ সালে হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে প্রকাশিত শচীনকর্তার প্রথম রেকর্ডটি তাই পল্লীর নিখাদ লোকসংগীত নয়, হেমেন্দ্রকুমার রায় ও শৈলেন রায় এর কথায় ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে মাঠের বাটে যাই’ ও ‘এই পথে আজ এস প্রিয় করো না আর ভুল’(সরগমের নিখাদ)। স্মর্তব্য, এ্ররও আগে এইচএমভি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল তাঁর কণ্ঠের কথিত ত্রুটির কারণে, মানে আনুনাসিক স্বরের কারণে। নগরের শিল্পীদের রেওয়াজি, পলিশড কন্ঠের পাশে শচীনকর্তা বেমানান, পরিবেশনের অযোগ্য! তো বম্বে এসে ’শচীনকর্তা’ ‘এসডি বর্মণ’ নামে রীতিমতো হিট! নগর ও বাজারের এই প্রবণতাটিকেও বিবেচনায় রাখার অনুরোধ জানাই। এ যেন সিনেমায় নতুন নায়ক নায়িকা এসেছে, গেঁয়ো নাম গন্ধ মুছে আধুনিক ’শাবানা’ হয়ে উঠতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ লোকসংগীত শিল্পী আবু বকর সিদ্দিক ঢাকায় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এক অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে তরুণ বয়সে ঢাকার অনেকেই তাঁকে বলেছিল নাম পাল্টে একটু স্মার্ট, আধুনিক নাম নিতে, তাতে জনপ্রিয়তা পেতে সহজ হবে। আধুনিক করে তোলার এই প্রকল্প পণ্যসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাল আমলে জনিপ্রয় ক্রিকেট তারকাদের নামকরণেও এর নমুনা খুঁজে পাবেন ( যে প্রক্রিয়ায় নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত মাশরাফি হয়ে যান ম্যাশ, মুস্তাফিজ হয়ে যান ফিজ’!!!) । এই যে আধুনিক করে তোলা, পরিশীলিত করে চকচকে পণ্য করে তোলার প্রকল্পে মূল বস্তু (Content) তার স্বকীয় পরিচয় (Form) হারায়, মৌলিকত্ব হারায় এবং সর্বোপরি নিজস্ব ভুমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সযত্ন দৃষ্টি না থাকলে বিলুপ্তিই ভবিতব্য এবং সেটাই ঘটছে লোকসংগীতের ভাগ্যে। এই আত্মসমর্পণের গল্পের পাশে দ্রোহী স্বরও আছে। গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানীর এরুপ হঠকারিতায় বাঁধ সেঁধেছিলেন আরেক কিংবদন্তী আব্বাসউদ্দীন আহমদ(১৯০১ – ১৯৫৯) । উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া অবিকৃতভাবে রেকর্ড করতে বাধ্য করেছিলেন ক্যাসেট কোম্পানিকে এবং তারই ফলশ্রুতিতে রেকর্ড হল ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’। তবে পরবর্তীতে তাঁকেও আপোষ করতে হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। ‘নদীর নাম সই কচুয়া’ গানেটির সুরে ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা’ লিখলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠে সেটি রেকর্ড হল এবং জনপ্রিয় হল। অখ্যাত, অনাম্মী কোন এক গ্রামীণ কবির রচিত গ্রামীণ ভাষার গান অনুমোদন পেলনা! জনতোষণ কিংবা বাজারের চাহিদামাফিক পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে নগরের দাবিই পুরণ করতে হয়েছে। কবি জসীম উদ্দীন আক্ষেপ করে বলেছেন –
আব্বাসকে গান শেখানো এক ধৈর্যের ব্যাপার। তখনও তার মনে তেমন সুরের সুক্ষ্ম সৌন্দর্যানুভূতি জোগে নাই । আমি কোন গ্রাম্য গানে হারমোনিয়াম বাজানো পছন্দ করি না। আব্বাস তাহা মানিত না, আমার রচিত ‘আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় চড়তাম না’ গানটিতে আব্বাস এক জায়গায় গান থামাইয়া খানিকক্ষণ হারমোনিয়াম বাজাইয়া লইয়াছে । তাহাতে গ্রাম্য গানের আবহাওয়া যে ক্ষুন্ন হইয়াছে তাহা আব্বাসকে বুঝাইতে পারতাম না।
আব্বাস তখন খ্যাতির এমন উচ্চ শিখরে আরোহন করিয়াছে যে, সে যেভাবে যাহা গায় তাহাতেই লোকে ধন্য ধন্য করে। পূর্ব-বাংলার গ্রাম্য গানের যে, ঢংটি আছে, তাহা আব্বাসকে কিছুতেই শিখাইতে পারি নাই।
উক্তির দ্বিতীয় অংশে কবির পর্যবেক্ষণ বিশেষ বিবেচনার দাবী রাখে। আব্বাসউদ্দিন আহমদ এর মত কিংবদন্তী শিল্পীদের হাত ধরেই কিন্তু লোকগানের পথরেখা নির্মিত হয়েছে, তাঁদের দেখানো পথেই হেঁটেছে বাংলা গান। সুরে, নির্মাণের বিচ্যুতিচিহ্নসমূহ পাঠ ও সমাধানের সক্ষমতা তাঁদের হাতে ছিল যদিও তা সবসময় সমানভাবে কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারেনি। সৃষ্টির ভান্ডার যখন বিশাল তখন স্ববিরোধ, বিচ্যুতির সম্ভাবনাও বেশি। যে আক্ষেপ কবি জসীম উদ্দীন করছেন আব্বাসউদ্দীনকে নিয়ে, সেই জিজ্ঞাসার মুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি নিজেও, স্বীকার করেছেন যে লোকগান জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে কোথাও কোথাও আপসরফা করতে হয়েছে, কথার পরিমার্জন করতে হয়েছে, সুরেরও তবে তা কখনো ঔ গানের নিজস্ব ভুগোলকে অতিক্রম করেনি। এই প্রসঙ্গে শাহ আবদুল করিম এর সাথে কালিকা প্রসাদ ভাট্টাচার্যের আলাপচারিতা স্মর্তব্য। কালিকাপ্রসাদ জানাচ্ছেন যে , শাহ আব্দুল করিম তাঁরই একটি গানে (আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম) বিদিত লাল দাসের করা ভিন্ন একটি সুরকে স্বীকৃতি দিয়ে বলছেন যে তিনি (বিদিতলাল দাস) ’পরদেশী কোন’ সুর দেয়নি। শচীনকর্তা মীরা দেব বর্মণের লেখা ‘সুবল বল বল বল চাঁই’ গানটিতে সচেতনভাবে ‘চাঁই’ শব্দটি অবিকৃত রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে সলিল ঘোষকে বলেছেনে – ’বৃঝলে সলিল, গ্রাম্য কথাগুলো রক্তের সাথে মিশে আছে। এতদিন গ্রাম হয়ে থেকেও এখনও সেই কথাগুলো ঘুরেফিরে মনে আসে আমাদের দেশে ’চাঁই’ কথাটি ব্যবহার হয়। যেমন- কোথায় হেঁ চাঁই বল দেখি” (সরগমের নিখাদ)। লেখার শুরুর দিকে যাদের নাম করেছি তাঁদের মধ্যে অমর পাল বুঝি ব্যাতিক্রম, কারণ তিনি নীরিক্ষার পথে হেঁটেছেন কম, উপরন্তু তাঁর শিল্পী পরিচয়টাই প্রধান হয়ে থেকে সতত। তাঁর জনপ্রিয়তাকে পাঠ করে বরং নগরের অধিপতিদের মানসিকতা যাচাই করা সহজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করা এই কিংবদন্তী বাংলাদেশে সেই অর্থে বর্তমান প্রজন্মের কাছে ব্যাপক আদৃত নন। দেশভাগের অভিঘাতে অলক্ষ্যে ভেঙ্গে গেছে বাংলা গানের সাঁকো। অমল পালকে বরং পশ্চিমবঙ্গের প্রথিতযশা শিল্পী বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া সহজ , তাঁর জনপ্রিয় (হিট) গান ’কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ গানের শিল্পী কিংবা প্রভাতী গানের কিংবদন্তী বলে চিহ্নিত করা সহজ! এই আপাতনিরীহ প্রবণতাটিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা সমুচিৎ। লেখার শিরোভাগে বরৈছিলাম যে নগর ‘স্বীকৃতি’ প্রদানের মাধ্যমে মূলত মোড়লিপনা করে, বাইনারি তৈরি করে। সুতরাং অমর পালকে তার বিপুল গানের রাজ্য থেকে আলাদা করে শুধু প্রভাতি গানের কারবারি করে তোলাটাও সেই ক্ষমতা চর্চার ধারাবাহিকতা মাত্র, সে আলাপ তোলা রইল। আপাতত শুধু এই আধিপত্যকামী প্রবণতাকে পাঠের কেন্দ্রে ধরে রাখতে চাই। অমর পাল এর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার নেপথ্যে আছে লোক সংগীতে তাঁর অগাধ দখল যেটি তিতাসের তীরে তাঁর আশৈশব অর্জন। লোকগানে গাঁর হাতেখড়ি মায়ের কাছে ফলে মৃত্তিকালগ্ন সুরটি অন্তরে প্রোথিত আছে দৃঢ়ভাবে। নগরে এসেছে আরেকদফা শিক্ষালাভ হল নগরের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনে এবং তারপর উচ্চাঙ্গ সংগীতের পাঠ। লোকসঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে এমন যুগলবন্দী দুর্লভ, নগর এই চমৎকারিত্বকে, নতুনত্বকে, পরিমার্জিত (!) নিবেদনকে লুফে নেয় ফলে তিতাসের মত কোন নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের গায়েনের কণ্ঠের গান শতভাগ অবিকৃত থাকে না গ্রামাফোন রেকর্ড, আকাশবাণীর আয়োজনে কিংবা চলচ্চিত্রে। শিকড়ছেদ এর শুরুটা এখানেই। প্রণম্য শিল্পীদের নাম করে মূলত এ বিবর্তনের কালপর্ব চিহ্নিত করতে চাইছি। ভক্তির প্রাবল্য, একাডেমিয়ার উদাসীনতা, সমালোচনাকে চুড়ান্ত নেতিবাচতায় সীমাবদ্ধ করে, সাধারণত এ আলাপগুলোকে সংগীতের তত্ত্ব পেরিয়ে এর সমাজতত্ত্ব পাঠে সম্প্রসারিত হতে দেয়নি, আখেরে ক্ষতি হয়েছে বাংলা গানের। নাগরিক তথা আধুনিক যুগের সাহিত্যের পুরোধা হয়েও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বরং সযত্ন দৃষ্টি রেখেছিলেন এদিকে। ’সংগীতচিন্তা’ সর্বতোভাবে লোকসংস্কৃতির দিকে আলো না ফেললেও সুর, স্বর ও সংগীতের স্বরূপ পাঠের দারুণ প্রতর্কের অবতারণা করেছেন। কবিগুরু বরং তাঁর ‘গ্রাম্যসাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে পল্লীর শিল্পসাহিত্যের প্রতি সযত্ন দৃষ্টি রেখেছেন, নাগরিক পাঠাতনে এর অনাদরকে নিন্দা করেছেন। যে বিকৃতি আর বিচ্যুতির চিহ্ন পাঠের চেষ্টা করছি আজ, কবিগুরু ১৩০৫ বঙ্গাব্দেই সেই বিষয়ে আলাপের সূত্রপাত করেছেন। কবির বয়ানে- ‘’ কেবল সম্প্রতি অতি অল্পদিন হইল আধুনিক কাল, দূরদেশাগত নবীন জামাতার মতো নূতন চাল-চলন লইয়া পল্লীর অন্তঃপুরেও প্রবেশ করিয়াছে। গ্রামের মধ্যেও পরিবর্তনের হাত পড়িয়াছে।” এই প্রবন্ধেরই অন্যত্র বলেছেন-
গ্রাম্যসাহিত্যের মধ্যেও কল্পনার তান অধিক থাক্ বা না থাক্ সেই আনন্দের সুর আছে। গ্রামবাসীরা যে জীবন প্রতিদিন ভোগ করিয়া আসিতেছে, যে কবি সেই জীবনকে ছন্দে তালে বাজাইয়া তোলে সে কবি সমস্ত গ্রামের হৃদয়কে ভাষা দান করে। পদ্মাচরের চক্রবাক সংগীতের মতো, তাহা নিখুঁত সুরতালের অপেক্ষা রাখে না। মেঘ-দূতের কবি অলকা পর্যন্ত গিয়াছেন, তিনি উজ্জয়িনীর রাজসভার কবি; আমাদের অখ্যাত গানের কবি কঠিন দায়ে পড়িয়াও পাবনা শহরের বেশি অগ্রসর হইতে পারে নাই–যদি পারিত, তবে তাহার গ্রামের লোক তাহার সঙ্গ ত্যাগ করিত। কল্পনার সংকীর্ণতা-দ্বারাই সে আপন প্রতিবেশীবর্গকে ঘনিষ্ঠসূত্রে বাঁধিতে পারিয়াছে, এবং সেই কারণেই তাহার গানের মধ্যে কল্পনাপ্রিয় একক কবির নহে, পরন্তু সমস্ত জনপদের হৃদয় কলরবে ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে।
আমাদের দূর্ভাগ্য এই যে, রবীন্দ্রচর্চার বিপুল প্রসারের সালে রাবীন্দ্রিক(!) পন্ডিতকুলের আগ্রহের এতটুকু ভার কবিগুরুর আগ্রহের সমানুপাতে লোকসংগীতের প্রতি জারি থাকে না। রবীন্দ্রচর্চা তথা নগরের আঙ্গিনায় লোকসঙ্গীত অপরায়নের সীমা পেরুতে পারে না। গত শতকের আশির দশকে লোককবি নিবারণ পন্ডিত রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনে বাঁধা দেয়ার খবর শুনে ব্যাথিত মনে যে লিখেছিলেন ‘মূর্খ গীদাল হামরাগুলা ভাওয়াইয়া গান গাই’’ (গণসংগীত সংগ্রহ, সম্পা:-সুব্রত রুদ্র, পৃ-৮৮) সে খবর নগরে উদযাপিত হয় না কিংবা নিবারণ পন্ডিতের গান তথাকথিত শিক্ষিত লোকের আসরে পরিবেশিত হয় না। নিবারণ পন্ডিতের গানের ভাষাও যে আজ বড্ড অপরিচিত। উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায়, ’গীদাল’ হচ্ছেন গ্রাম্য লোককবি যিনি দোতারা বাজিয়ে গান করেন। তো গীদাল শব্দ তার মানে হারিয়েছে মার্জিত শহুরে রুচির কাছে। কবিগুরুর কথায় ফেরা যাক। লোককগানের পসরা সাজানো কবি একলা গান করেন কিন্তু তার গানের বেদনা ব্যাষ্টির ভাব বহন করে, এমনকি সেই গানের ভণিতায় কবির নাম বুনে দেয়া থাকলেও। ভাইবে রাধারমন বলে ভণিতায় লীন হয়ে আছে ঐ জনপদের সমস্ত মানুষ। লোকগানের শক্তি ও সৌন্দর্যের জায়গা এখানেই। এই নাগরিক বাস্তবতায়, যৌথ পরিবার ভেঙ্গে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মানুষ হয়ে ওঠা শ্রোতার কাছে সমষ্টির এই ভাব হৃদয়ঙ্গম করা দূরহ। বিনয় ঘোষ তাঁর মেট্রোপলিটন মন গ্রন্থে লিখেছিলেন যে , “পুরুষ ও নারীর জৈবিক ভেদাভেদও জনপিণ্ডের স্টীমরোলারের চাপে দলিতমথিত। কারো কোন অঙ্গের সামান্য স্বাতন্ত্র্যবোধও নেই, যেন কেউ রক্তমাংসের মানুষ নয়, প্রত্যেকে রবার ও প্লাস্টিকের পুতুলের মতো একটা বৈদ্যুতিক শক্তির ক্রিয়ায় চলাফিরে বেড়ায়, ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।’’ এই মোট্রাপলিটন নগরে মানুষ স্কন্ধকাটা মানুষ হয়ে নির্বিকার হেঁটে যায়, তার চৈতন্যে আঘাত করতে চাই বিস্ফেরণের শব্দ, এজন্য রক কনসার্টের হুল্লোড় তাকে কিছুক্ষণের জন্য হয়তোবা যুক্ত করে। মগ্ন চৈতন্যের আবেদন তার সামনে নিরর্থক প্রায় ! এই যে জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, মানুষের সাথে, কাজের সাথে সম্পর্কছেদের খতিয়ান পাঠ করেছিলেন কার্ল মার্কস ক্যাপিটাল প্রথম খন্ডের লেবার প্রসেস অধ্যায়ের আপাত সাধারণ একটা বাক্যে – “The less he is attracted by the nature of the work and the way in which it has to be accomplished, and the less, therefore, he enjoys it as the free play of his own physical and mental powers…”।
মার্কসাবাদী তত্ত্বের সাধারণ বয়ানটিকেই যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখব উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে মানুষের জীবনের সমূহ বিষয় জড়িত। অবসর যাপন তার কাজ হতে বিচ্ছিন্ন কিছু বা নিছক ফূর্তি নয় বরং কাজের ধারবাহিকতা। লোকসংগীতের ইতিহাসে তাই শ্রমসংগীতের এত প্রকরণ সদা হাজির। মাঝি মাল্লাদের গান ‘সারি গান’ তেমনি শ্রমসংগীত কিন্তু এটা ভাটিয়ালী হতে আলাদা। এর গতি দ্রুত, সুরের দৈর্ঘ্য কম এবং এটি দলয়ি সংগীত। ভাটিয়ালী বরং একলা গায়কের গান। এর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এর সুরের গঠন । ভাটিয়ালী ঔড়বজাতীয় বা মূলত পঞ্চস্বরের গান হলেও আরোহন অবরোহন মিলিয়ে প্রায় সবকটি স্বরই এতে লাগে। এ এক আশ্চর্য প্রকরণ যা লোকসংগীতে দুর্লভ। এ কারণেই ভাটিয়ালী দাপটের সাথে অন্যান্য গানে ঢুকে পড়েছে, কীর্তন, বাউল গানকে আত্মীকরণ করে ফেলেছে। বিষয়ের বিবেচনায় ভাটিয়ালীর বর্তমান রূপটিকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন গবেষক ওয়াকিল আহমদ – লৌকিক প্রেম, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এবং আধ্যাত্মিকতা। বিষয়ের আগমনসূত্রে তার কালক্ষণ যথার্থরূপে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগে ভাটিয়ালীর সদর্প উপস্থিতির নিশ্চিত প্রমাণ আছে বাংলা সাহিত্যের নানা উপাদানে। চৈতন্যেত্তরকালে কীর্তনের ঢেউ এসে লাগল ভাটিয়ালতেও। প্রাচীন ভাটিয়ালীতে লৌাকিক প্রেমের, নিত্যকার জীবনের আলাপ ছিল মূখ্য, এবার সেখানে লৌকিক প্রেমের গল্পে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমোপাখ্যান এসে পড়ল। উল্টোদিক থেকে দেখলে দেখা যাবে কীর্তনে ভাটিয়ালীর সুর জায়গা করে নিচ্ছে। অবশ্য ভাটিয়ালীতে রাধা-কৃষ্ণও লৌকিক নায়ক-নায়িকা হিসেবেই ছিলেন বলা চলে। কানু, কানাই, কালা, শ্যাম ইত্যাকার সম্বোধনে যে গান রচিত হত তাতে লৌকিক, পার্থিবতার আবাহন। যেমন- আমি তোমার প্রেমের পাগলিনী/আমার শ্যাম গুণমণি, লোকে মন্দ বলে রে/ ঐ না ঘাটে গেলে রে/রূপের পাগল হইলাম রে/জলের ঘাটে গিয়া, চিকন গোয়ালিনী/রসের বিনোদিনী/এইরূপ যৌবন তোমার জোয়ারের পানি, কোন বা দ্যাশে রইলারে নইদ্যার চান/আমি তোমার লাগিয়া যোগিনী হব গো/রাখব না আর কুল মান। শেষোক্ত গানটি বাইদ্যার গান। এই পর্বে সারি গানের সাথেও কিছুটা লেনদেন ঘটেছে ভাটিয়ালীর অবশ্য সেগুলোকে এককভাবে চিহ্নিত করা তর্কসাপেক্ষ। মুস্তাফা জামান আব্বাসী ভাটির দ্যাশে ভাটিয়ালী গ্রন্থে ভাটিয়ালীর তালিকায় বেশ কিছু সারি গানকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন আবার আলোচনার এক জায়গায় সারি ও ভাটিয়ালীকে একই ধরণের গান হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। একই লেখার অন্যত্র আবার দুই ধরণের গানের স্বকয়ি বৈশিষ্ট্রের কথাও বলেছেন। গোলমালটা বাঁধে এখানেই। নদী সম্পর্কিত, মাঝিমাল্লার গান মানেই ভাটিয়ালী নয়। ড. আশেুতোষ ভট্টাচার্য চর্যার কবি ভুসুকুপার একটি পদকে আশ্রয় করে ভাটিয়ালী রাগের আদি নমুনা হিসেবে পাঠ করতে চেয়েছেন কিন্তু সেই গানের চিত্রকল্প বিশ্লেষণ করে ওয়াকিল আহমদ তা নাকচ করেছেন। উল্লেখ্য ভাটিয়ার/ভাটিয়ারী নামে স্বতন্ত্র একটি রাগের উল্লেখ পাওয়া যায় যা ভাটিয়ালী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিবেশের সাথে ভাটিয়ালী দারুণভাবে সম্পৃক্ত। গায়কের ভাব , মেজাজ, গায়নের সময়কাল সাপেক্ষে ভাটিয়ালীর সুরের বিস্তার ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়। হেরাক্লিটাসের উক্তির অনুকরণে বলা যায় -একই ভাবের নদীতে দুইবার ডুব দেয়া যায় না, ফলে ভাটিয়ালীর সুরের সাধারণ কাঠামো পাঠ করে এক চিহ্নিত করা সম্ভব কিন্তু নিখাদ স্বরিলিপি প্রস্তুত অসম্ভব প্রায়। আর স্রেফ স্বরলিপি অবলম্বন করে সেই ভাবের দরিয়ার থৈ পাওয়া ভার। নগরের পরিমন্ডলে এসে ভাটিয়ালীর বিপদ ঘটে এখানেই। নদী, মাঝি মাল্লার অনুষঙ্গ এলেই অটিয়ালীর সুরারোপ করে একটা কিছু দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়, তাতে শ্রোতার নিকট সাময়িক আবেদন তৈরি হয় হয়তোবা কিন্তু ভাটিয়ালীর অঞ্চলজাত চিত্রকল্প অধরা থেকে যায়। প্রতিবেশ এর সাথে সম্পর্ক লুপ্ত করে দেয়ার প্রবণতাটাকেই মূল সমস্যা হিসেবে দেখতে চাই।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, কবি জসীম উদ্দীন লোকগান রচনার ক্ষেত্রে প্রচলিত লোকগান থেকে নানা উপাদান ব্যবহার করেছেন এবং তিনি তা অকপটে উল্লেখও করেছেন (গানের বাহিরানা দ্রষ্টব্য)। যেমন –’রঙ্গিলা নায়ের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত একটি ভাটিয়ালী –
আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি।
তুমি এই ঘাটে লাগায়ারে নাও
নিগুম কথা কইয়া যাও শুনি।
তোমার ভাইটাল সুরের সাথে সাথে কান্দে গাঙের পানি,
ও তার ঢেউ লাগিয়া যায় ভাসিয়া কাঙ্খের কলসখানি।
গানটির মূল গীতকার শেখ ভানু, কবি জসীম উদ্দীন মুখরাটুকু নিয়ে নতুন গান রচনা করেছেন এবং তা জনপ্রিয় হয়েছে। লোকসংগীতের ক্ষেত্রে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি পরবর্তীতে এমন ব্যাপকভাবে ঘটেছে, অনেক গানের ক্ষেত্রেই, ভুল গীতকারে নামে চলেছে গান কিংবা মূল গীতকারের নাম মুছে গেছে কবেই । জসীম উদ্দীনের গান গ্রন্থভুক্ত আছে ফলে তার গান নিয়ে নিবিড় পাঠের সুযোগ আছে বলা যায় এবং সেটা জরুরি। গানটির কথায় ফিরি, এই গানে ভাটি অঞ্চলের দৃশ্যকল্প, তার প্রতিবেশ কি দারুণ করে বিবৃত আছে ছত্রে ছত্রে। গানের ভেতর কোথাও যেন এক দরদের জাল বিছানো, কি অকপট আকুতি ‘নিগুম’ কথা শুনবার। অনলাইনে গানের লিরিক খুঁজতে গিয়ে কোথাও কোথাল ‘নিঘুম’ লিখতেও দেখলাম। গীদাল এর মত ’নিগুম’ও বুঝি অপরিচিত শব্দ । শব্দচয়নের মাধুর্য অনেকক্ষেত্রেই নগরের চাহিদামাফিক ঘষামাজা করা হয়েছে, হচ্ছে তা আগেই বলেছি তবে অনেক লোককবিদের লেখায়ও নতুন ভাষার উদ্ভাস দেখা গেছে যা প্রমিত ভাষার অনুরূপ কিন্তু ভাবেরে ঐশ্বৈর্যে মৃত্তিকালগ্ন, জনমানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি, যেমন- কবিয়াল বিজয় সরকার, মহর্ষি মনমোহন দত্ত। তাঁদের রচনায় বৈষ্ণব ভাব, আধ্যাত্মভাবের জোয়ার প্রবল, ভাষার সৌন্দর্যগুণ অসামান্য এবং সরলতার অপূর্ব বয়ান যা গণমানুষকে এবং শহুরে শিক্ষিত সমাজকেও আকৃষ্ট করেছে। বিজয় সরকার আবার বিচ্ছেদী গানের কবিয়াল। বিচ্ছেদী, বিরহী ভাব ভটিয়ালীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। গায়কের এই বৈরাগ্য ভাব, উদাসীন মেজাজ ক্রমে ভক্ত, পূজারী আর বাউলের আধ্যাত্মভাবে সাথে মিশে গেছে। ফলে চৈতন্যোত্তর যুগের ভাটিয়ালী দার্শনিকতায় আকীর্ণপ্রায়। এই পর্বে গানের ভনিতায় পদকর্তার নাম যুক্ত হতে লাগল। সিলেট অঞ্চলের অনেক খ্যাতিমান লোককবি যেমন রাধারমণ, হাছন রাজা, উকিল মুন্সী, শেখ ভানু প্রমুখের নাম পাই আমরা এরই সূত্রে। এই ভাবধারার জনপ্রিয় গান হল – মন মাঝি তোর বৈঠা নেড়ে/ আমি আর বাইতে পারলাম না । এরপর ক্রমশ তত্ত্বকথার আলাপ ঢুকে পড়েছে লৌকিক জীবনের গল্পের রূপকে, প্রতীকে।
কালো মেঘে সাঁঝ কইরাছে পরান তো মানে না
সাবধানে চালায়ও তরী নাও যেন ডুবে না বা
নাইয়া , নদীর কুল পাইলাম না
অরে , ও সুজন নাইয়া, নদীর কুল পাইলাম না
ঢাকা শহরে প্রেম বাজারে প্রেমের বেচা কেনা
মদনগঞ্জের মহাজন মারা ঐ ঘাটে লাগাইয়া না বা
নাইয়া ,নদীর কুল পাইলাম না
ভেবে রাধারমন বলে নদীর পারে বইয়া
পার হইমু পার হইমু কইরা আমার দিন তো গেলো গইয়া বা
নাইয়া, নদীর কুল পাইলাম না
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে ধারণকৃত)
নির্মলেন্দু চৌধুরীর কণ্ঠে কিছুটা ভিন্ন পাঠ:
নাইয়া রে, সুজন নাইয়া
আমি নদীর কুল পাইলাম না।
কালো মেঘে সাঁঝ কইরাছে পরান তো মানে না
তুমি কিনারা ভিরাইয়া ধইরো নাও যেন ডুবে নারে সুজন নাইয়া।
ঢাকা শহরে রং বাজারে রঙের বেচা কেনা
মদনগঞ্জের মহাজন মারা সেই ঘাটে যাইও নারে সুজন নাইয়া।
নাইয়া রে-
ভাইবে রাধারমন বলে এই পাড়ে বইয়া
তুমি সকলরে তরাইলে গুরু
আমার দিন তো গেল বইয়া রে।
প্রতিবেশের গল্প আগেই করেছি, এখানে শুধু তা মিলিয়ে নেয়ার পালা। ময়মনসিংহ গীতিকায় আমরা নানান রকম মেঘের বর্ণণা পেয়েছি এখানে তার উৎপ্রেক্ষার নমুনা পাঠ করা সম্ভব। গানের কথায় সমসাময়িক দুই শিল্পীর রেকর্ডে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বিদ্যমান। নির্মলেন্দু চৌধুরীর রেকর্ডে ‘গুরু’, ’রঙ’ শব্দ দুটি ঢুকে পড়েছে, কথা ও মেজাজ পাল্টেছে বেশ। এই পালিশ করার প্রবণতা হেমাঙ্গ বিশ্বাস গ্রহণ করতে অরাজি ছিলেন। তিনি নিজে সর্বতোভাবে ভাটিয়ালীর নিজস্ব মেজাজ অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট ছিলেন, কতটুকু, কোথয়, কী কারণে আপস করতে হবে তা নিয়ে সতত সতর্ক ছিলেন। লোক আঙ্গিকের গান আর লোক গান এ দুয়ের তফাৎ নিয়ে সচেতন ছিলেন সবসময়। কবি জসীম উদ্দীনের হাতে লোক সংগীতের নবরুপায়ন মেনে নিয়েছিলেন কারণ তাঁর শিকড় ছিল আদ্যোপান্ত পল্লীর মাটিতে প্রোথিত, এই জনপদ, এর প্রতিবেশ, মানুষ তাঁর চিরচেনা সুতরাং তাঁর সৃষ্টিতে এসব ঊনপরিচয় পায় নি বরং স্বতস্ফূর্ত এক নতুন উদ্ভাস হয়ে এসছে। ’ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’ তে সারি গানের আদলে দ্রুতলয়ের কটি লাইন জুড়ে দিয়েছেন যা ঠিক অচেনা লাগেনা এতটুকু। শচীনকর্তা যখন লোকগান আর মার্গসংগীত এর সংমিশ্রণে নতুন সুরে বম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মাৎ করছেন তখনও ভাটিয়ালীর সুর চকিত মাথা তোলে স্বমহিমায় আর কর্তা আজীবন সেই পল্লীর সুটিই ধরে রেখেছিলেন তাঁর গায়নে। নিবিষ্ট শ্রোতা কান পাতলে দেখবেন পারেন সুজাতা চলচ্চিত্রে ‘শুন মেরে বন্ধুয়া’ আর পরবর্তীতে আরডি বর্মণের সংগীতায়োজনে কিশোর কুমারের কণ্ঠে ‘ও মাঝিরে, নদীয়া কিনারে’ গানেও ভাটিয়ালীর জমিন কীরূপে হয়েছে ঐশ্বর্যমন্ডিত। একইভাবে আব্বাসউদ্দীন আহমদও ছিলেন এই জনপদের ব্যাষ্টির কণ্ঠস্বর। তাঁদের মৃত্তিকালগ্ন সংগীত সাধনা তাই শেষ পর্যন্ত অধিকারের প্রশ্নে মান্যতা পেয়ে গেছে। কিন্তু তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে আধুনিকতার যে দাপট চলছে তাতে ভাটিয়ালী তথা বাংলা লোক গান যাদুঘরের প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু হয়ে উঠছে ক্রমশ। জি-টিভি’র রিয়েলিটি শো ’সারেগামাপা’তে কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের হাত ধরেও যে নতুন ফিউশনের জয়জয়কার তা কালিকাপ্রসাদের নিজের সংগীতচর্চার দর্শনের সাথে সর্বদা সাযুজ্য রাখেনা বলাই বাহুল্য। ঝুমুর, ভাটিয়ালী সব এক পাত্রে পরিবেশিত হচ্ছে সেখানে। কোক স্টুডিওর দাপটে আরেকরকমের বিপদ শুরু হয়েছে বাংলা গানে। গ্রামীণ গায়ককে দেশি বিদেশী হরেকরকমের যন্ত্রের হাটে বসিয়ে শুরু হল আরেক নিরীক্ষা, অনেকক্ষেত্রেই সংযমী সংগীত আয়েজনে তা উৎরে গেলেও একটু নিবিড় দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে পল্লীর সেই প্রতিবেশটি ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আয়োজনের ঝকমারিতে। ভাটিয়ালীতো একলার গান, এক আসরের গান করে তুললেই সর্বনাশ। বলছিনা যে সব বন্ধ করে দাও বরং বলতে চাই যান্ত্রিক নগরের গতির সাথে জোর করে ভাটিয়ালী মেলানোর আগে এর অন্তর্গত প্রাণটিকে বুঝে নেয়ার প্রয়াস থাকুক, প্রতিবেশ থেকে, জনজীবন থেকে যেন লুপ্ত হয়ে না পড়ে। এর জন্য চাই অভিনিবেশ, লোকগানকে জাতে তোলার নাগরিক মানসিকতার নিপাত । হেমাঙ্গ বিশ্বাস আজো এই প্রক্রিয়ার অনুসরণীয় পুরুষ। ’হবিগঞ্জের জালালী কইতর’ এ ভাওয়াইয়ার অনুরণন এসে পড়েছে কিন্তু এর মেজাজটিকে ক্ষুন্ন করেনি। গানের ছত্রে ছত্রে জনপদের সুর ও স্বরের প্রতি কী অসামান্য অনুরাগ। আজ নিদানকালে সেটাই মূল অবলম্বন হওয়া উচিৎ। ভাটিয়ালীর গান সংরক্ষণ, পাঠ ও প্রচারেও এই আন্তরিক অভিনিবেশটুকু চাই, নইলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ক্রমশ ফাঁপা গণবিমুখ উন্নয়নের হুংকারে পর্যবেসিত হবে, হচ্ছে।
ভাটিয়ালীর সংরক্ষণের আনুষ্ঠানিক উদ্যোগের লিখিত নজির পাওয়া যায় ১৩১৯ বঙ্গাব্দ থেকে।গ্রন্থভুক্ত হয়েছে যেটুকু তা যৎসামান্য। সংগ্রাহক, গবেষক, গায়ক এমনকি শ্রোতারও চাই ভাটিয়ালী তথা লোকসংগীতের সাঙ্গীতিক স্বাক্ষরতা, যেমনটি প্রস্তাব করেছিলেন আব্দুস শাকুর তাঁর ‘শ্রোতার কৈফিয়ত’ গ্রন্থে। এই স্বাক্ষরতাটুকুই হয়তো আমাদেরকে ভাটির সেই জলমগ্ন ভুমিতে দাঁড়ানো নিগম বাৎলে দেবে, মিউজোকলজি এবং এখনোমিউজিকোলজির আলাপ একাডেমির আয়তন পেরিয়ে গণমানুষের নিকটবর্তী করবে। নতুবা লালন মেলার নামে শহুরের গায়কদের কনসার্ট আয়োজনের মাধ্যমে, প্রাকৃতিক বন উজারের পর ‘ছাদ কৃষি‘ করে পরিবেশ বন্ধুসুলভ আত্মতৃপ্তি উপযাপনের সমতুল্য ভন্ডামিই সার হবে।
সেলাম তোমার পায়
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে কালোত্তীর্ণ আরেকটি গানের পাঠ দিয়ে আলাপের ইতি টানছি।
সেলাম চাচা, সেলাম তোমার পায়
বড় নাও এর মাঝি মোরে বানাইছে আল্লায়।
কইও গিয়া চাচীর কাছে
আল্লায় মোরে দিন দিয়াছে
গুনটানাটান ঘুইচ্যা গেছে বইসাছি পাছায়।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস গানটার ভাষ্যে বলতেন , “বুঝলা, ‘গুণটানা নাইয়া’ নৌকার ‘হাইলধরা’ প্রধান মাঝির পদে ‘প্রোমোশন’ পেয়েছে। শ্রমজীবনের এর চেয়ে বড়ো সাফল্য আর কি থাকতে পারে? তাই বাপ-মা-মরা- ছেলেকে যে-চাচী মানুষ করেছিল, তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা সুরে সুরে নির্জন পল্লীর বাতাসকে মুখর করে তুলেছে সে খোকা। কী এক অপূর্ব আত্মীয়তার ছবি ধরা আছে এই গানে। সকৃতজ্ঞ কিশোর যখন চাচীকে তার আনন্দের কথা জানাচ্ছে তখন মানবিক সম্পর্কের এক অব্যাক্ত উষ্ণতা শ্রোতাকে জারিত করে। যাপনের আনন্দ, প্রেম, লোকায়ত জীবনের দর্শন এখানে দারুণ মিথষ্ক্রিয়া করে রচনা। নিজের শ্রমের অর্জন ও উপার্জনকে এমন অকৃত্রিমতায় আঁকতে হলে পলিমাটির ঘ্রাণটুকু চেনা চাই, তাকে আপন করে বোঝা চাই। আধ্যাত্মিক ভাবের গানের ধারা ভাটিয়ালী সুরে জারিত হলেও তা মূলত এই লৌাকিকতারই অন্যতর সম্প্রসারণ। এর প্রভাবে ভাটিয়ালী গানে নিত্যকার জীবনের শোষন বঞ্চনার প্রতিবাদী স্বরগুলি ক্রমশ ভাববাদিতায় লীন হয়ে গেছে। ‘আমার ভাবনা কিন্তু দূর হইল না /শুনেন গো মুরশিদ’ গানের প্রতিবাদী স্বরটা এখন আর উচ্চকিত নয়। সমাজব্যবস্থার পালাবদল, শ্রমব্যবস্থার পরিবর্তন, ধর্ম ইত্যাদির উপস্থিতি এই স্বরটাকে প্রভাবিত করেছে চরমভাবে। এই ফারাকগুলো জ্ঞাত অজ্ঞাতসারে গুলিয়ে ফেলছে আধুনিকতার কান্ডারিরা। গীদালের মত তার দোতারা, সারিন্দা ক্রমশ হার মানছে সর্বসুরের যাদুর বাক্সের কাছে। এইসব বিপদচিহ্ন স্বীকার করে নিয়েই মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে। ’বাংলার মাটি বাংলার জল’ প্রবন্ধে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর উচ্চারণকেই সমর্থন করেই আশাবাদী মন নিয়ে আলাপের সমাপ্তি টানছি-
’বিশ্বায়নের বিজয়রথের ওপরে ধনগৌরবের যে পতাকাটা পতপত করে উড়ছিল , বাংলার মাটিতে পা রাখার পর দেখা যাচ্ছে সেই রথে ধনগৌরবের পতাকার পাশে আরও উঁচু একটি পতাকা খাড়া করে দেওয়া হয়েছে; আর সেই পতাকার একপিঠে রয়েছে জ্ঞানের চিহ্ন অন্য পিঠে রয়েছে প্রেমের চিহ্ন। বাংলার মাটিতে বিশ্বায়নের রথকে চলতে গিয়ে এই পরিবর্তনকে মেনে নিতেই হচ্ছে, অন্যথায় তার চাকা গেড়ে যাচ্ছে বাংলার মানুষের মনলোকের জলাশয়ের কাদায়। জ্ঞান ও প্রেমের শ্রেষ্ঠত্বকে যথোপুযুক্ত মর্যাদা না দিলে সে রথকে কিছুতেই টেনে তোলা যাচ্ছে না, যাবেও না কোনদিন।
তুমি সাবধানে চালাইও মাঝি আমার ভাঙ্গা তরী।

লেখক পরিচিতি
হুমায়ূন আজম রেওয়াজ
নাট্যকর্মী
সহায়ক পাঠ :
১. জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা-স্মরণ মোহিনী চৌধুরী : প্রণয় বিরহ মুক্তি জাগরণের গীতিকবি, আবুল আহসান চৌধুরী, কালি কলম, মার্চ ২০১০
২. বাংলা লোকসংগীতঃ ভাটিয়ালী গান, ওয়াকিল আহমদ, লেখক সমবায়, ২০০০
৩. ভাটির দ্যাশে ভাটিয়ালী, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১০
৪. সংগীতচিন্তা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ২০১০
৫. শ্রোতার কৈফিয়ত, আবদুশ শাকুর, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স
৬. বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাঠ্য পালাগান, ইউসুফ হাসান অর্ক, বাংরা এহাডেমী, ২০১৮
৭. গানের বাহিরানা , হেমাঙ্গ বিশ্বাস, প্যাপিরাস, ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ
৮. বঙ্গীয় লোকসংগী রত্নাকর, ড. শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য, পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি গবেষণা পরিষদ, ১৯৬৭
৯. বাংলার লোকসাহিত্য, ড. শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য, ক্যারখাটা বুক হাউস, ১৯৬২
১০. গ্রাম্যসাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১১. সরগমের নিখাদ, শচীন দেব বর্মন, অলকানন্দা পাবলিশার্স , ২০১৭
১২. মেট্রোপলিটন মন, মধ্যবিত্ত, বিদ্রোহ , বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাক সোয়ান , ১৯৭৩
১৩. বাঙালির গান, করুণাময় গোস্বামী, সাহিত্য প্রকাশ, ২০১৩
১৪. লোকসংগীত, সম্পাদনা- মুহম্মদ নুরুল হুদা, বাংলাদেশ এশিয়াটক সোসাইটি, ২০০৭
১৫. সঙ্গে কালিকা, সম্পাদনা- সুতীর্থ ঘোষ, সৃষ্টিসুখ, ২০১৯
১৬. সুন্দর হে সুন্দর, কলিম খান, রবি চক্রবর্তী, একুশ শতক, ১৪১৮ বঙ্গাব্দ
১৭. বিতার্কিকাঃ প্রসঙ্গ বাংলা গান, সম্পাঃ অভ্র ঘোষ, সেতু, ২০১৪