রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গান

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির যেকোন দিকের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের মনোভঙ্গীটি সামনে উঠে আসে। আর গানের আলোচনায় সেটা যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ সাধারণভাবে নিয়মের নিগড়ে বাঁধা জীবন ও আচারকে ভেঙে তাঁর নিজস্ব নিয়মে ঢেলে সাজিয়েছেন। তাঁর নিয়ম ভাঙার আওয়াজ সশব্দ না হলেও এর প্রভাব তাঁর ব্যাক্তিগত জীবন এবং তাঁর সৃষ্টিশীলতায় দৃঢ় এবং গভীর ভূমিকা রেখেছে। এই নিয়ম ভাঙার ছাপ এসে পড়েছে আমাদের শিল্পচর্চার জগতেও। রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে বিলেতি গান, বাউলের গান থেকে কীর্তনীয়ার সুর, সঙ্গীতের এমন কোন শাখা নেই যার থেকে নির্দ্বিধায় গ্রহন করেননি। আকন্ঠ গ্রহন করে তিনি ছেনে নিয়েছেন নিজের প্রয়োজন অনুসারে। সঙ্গীতে মৌলিক বলে, অবশ্য পালনীয় নিয়ম হিসেবে বা অপরিবর্তনশীল বা প্রচলিত জেনে যা মান্য হয়ে এসেছে দীর্ঘ কাল ধরে সেগুলো রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বভাব সুলভ কায়দায় ভেঙে নতুন করে গড়েছেন। তাঁর এই ভাঙা আর নির্মাণের ভেতর সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের গানের জগত।

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্রনাথের বৃহৎ গানের ভাণ্ডারের ছোট একটি অংশ তাঁর কীর্তনাঙ্গের গান। রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গানের কথায় যাবার আগে কীর্তন গানের প্রাথমিক আলোচনাটি করে নিতে চাই বলার এবং বোঝার সুবিধার্থে। কীর্তন বলতে বোঝায় যশোগাথা, সুখ্যাতি বয়ান বা মহিমা প্রচার। কীর্তন গানের বিষয়বস্তু মুলত ভগবানের নামগান, যশোগাথা, ভগবানের লীলা প্রচার, এছাড়াও রাধাকৃষ্ণের প্রেমও উঠে এসেছে কীর্তনের বিষয় হিসেবে। প্রথম কীর্তনের পদ রচয়িতা হিসেবে আমরা পাই বিদ্যাপতিকে কিন্তু বাংলায় কীর্তন গানকে লোকপ্রিয় করে তোলেন শ্রী চৈতন্য(১৪৮৬-১৫৩৩)। তাঁর প্রভাবেই কীর্তন গান প্রচার ও চর্চা প্রসার লাভ করে শুধু তাই নয় এই কীর্তন গানের ভেতর দিয়ে বড় সামাজিক পরিবর্তনও তিনি ঘটিয়েছিলেন। ফলে একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে বৈষ্ণব ভিক্ষুকের কন্ঠের কীর্তন গান সাধারন মানুষের মনের খোরাক হয়েছিল।

বাংলা কীর্তন গানের ধারা সুপ্রাচীন এবং সমৃদ্ধ হলেও এর ভাব, ভাষা, সুর ও গায়কী মিলিয়ে এটি ঠিক সমাজের উঁচু তোলার মানুষের সমাদর পায়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কোন শর্তে বাঁধা পড়বেন না, তাই কীর্তন গান তাঁকে আকৃষ্ট করে খুব অল্প বয়েসেই। এই বয়েসেই তাঁর হাতে আসে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ আর বৈষ্ণব পদাবলী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মুলত কীর্তন গান বিশেষ ভাবে শোনেন পুর্বাংলায় জমিদারি তদারক করতে এসে এবং তাঁর গানে কীর্তনাঙ্গের সুর বসানোর শুরুও এই সময়ে প্রথম। অল্পবয়েস থেকে রবীন্দ্রনাথের মনে ছাপ ফেলা কীর্তনের সুর, গীতগোবিন্দ ও বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব ও ভাষারই প্রভাব পড়েছিলো তাঁর পরবর্তী জীবনে কীর্তনাঙ্গের গান রচনায়। যেখানে তাঁর অল্পবয়েসে রচিত কীর্তনাঙ্গের গানে কীর্তনের ভাষা, সুরের প্রভাব যেমন প্রাথমিক ভাবে চোখে পড়ে তেমনি করে পরিণত বয়েসে তাঁর নিজস্ব ভাষা ও ভাবের ব্যবহার এবং মার্গ সঙ্গীতের সাথে কীর্তনের সুর মিলিয়ে নিয়ে নতুন ধরনের যে কির্তনাঙ্গের গান রচিত হলো সেগুলো আখ্যা পেল রাবীন্দ্রিক কীর্তন হিসেবে।

Rabindranath Tagore

আলোচনার শুরুতেই কীর্তন গানের বিষয়বস্তু নিয়ে লিখেছি সেখানে ভগবানের যশোগাথা বা মহিমার উল্ল্যেখ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গানের ভাষা ও সুর শুরুতে মূল কীর্তন গানের অনুসারি হলেও পরবর্তীতে সেখানে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়। রবীন্দ্রনাথের কীর্তন গানেও আমরা ঈশ্বরকে পাই। কিন্তু সেখানে ঈশ্বরের যশোগাথা প্রচারের চেয়ে মুখ্য হয়ে ধরা দেয় পরমেশ্বর, তিনি কেবল আধ্যাত্যলোকের সঙ্গী নন, তিনি বন্ধু, প্রিয়, প্রভু। কেবল ঈশ্বর নন রবীন্দ্রনাথের কীর্তন গানের কথায় জীবনবোধ, প্রেম,প্রকৃতি এবং মনের আকাঙ্ক্ষাও আমরা রূপ পেতে দেখি। সুরের ক্ষেত্রেও মূল কীর্তনের সরল অনুসরন থেকে সরে তিনি গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব শৈলী প্রয়োগ করে ভিন্ন আঙ্গিক দিয়েছেন। পরিণত বয়সে সুর করা কীর্তনাঙ্গের গান গুলো থেকে বাদ দিয়েছেন আখরের ব্যবহার। মার্গ সঙ্গীতের সুরের সাথে কীর্তনের সুর মিলিয়ে নিয়ে নতুন ধরনের সুরে বেধেছেন তাঁর কীর্তনাঙ্গের গান। এই প্রসঙ্গে আবারও সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে বলতে হয় প্রচলিত নিয়মের বাইরে দাঁড়িয়ে নতুনকে স্বাগত জানানোই রবীন্দ্রনাথের মনের প্রকৃতি।

রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গানের প্রসঙ্গে যে গানগুলোর কথা সহজে আমাদের মনে আসে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ভানু সিংহের পদাবলী। রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অল্প বয়েসে বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন। তের থেকে আঠারো বছর বয়সের সময়ে রচিত সাহিত্যে গুলো গুটিকয় বাদে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরবর্তী জীবনের সাহিত্য সংগ্রহে স্থান দেননি। যা স্থান পেয়েছে তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্যযোগ্য ভানু সিংহের পদাবলীর বাইশটি কবিতা যেগুলো পরবর্তীতে গান হিসেবে সংকলিত হয়। ভানু সিংহের পদাবলীতে রবীন্দ্রনাথ ব্রজবুলি ভাষার ব্যবহার করেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রও ব্রজবুলী ভাষায় কিছু কবিতা লিখেছেন কিন্তু এত যথার্থ ভাবে ব্রজবুলী ভাষার ব্যবহার রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ করেছেন বলে জানা যায়না। এর মধ্যে নয়টি গানের সুর পাওয়া যায় তারমধ্যে কয়েকটি বহুলশ্রুত যেমন গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে, মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান,সজনি সজনি রাধিকা লো,শুন লো শুন লো বালিকা,শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা ইত্যাদি। এ গান গুলোতে কীর্তনের ভাষা ও সুরের সরাসরি প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি যা কিনা রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়েসের কীর্তনাঙ্গের গানে আমরা পাইনা। আজকের আলোচনায় অল্প কয়েকটি গানের উল্লেখ্য করেই রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গানের বিষয় উপস্থাপন করতে চাই।

Signature of Rabindranath Tagore

ভানু সিংহের পদাবলীর প্রথম গান গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে। এ গানটির রচনা কাল ঠিক জানা যায়না, কারো কারো মতে এটি রবীন্দ্রনাথের ষোল বছর বয়সে রচিত তবে এই গানটি ভারতী পত্রিকার কার্তিক ১২৮৪ সংখ্যায় প্রকাশিত । এই গানের প্রসঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘলাদিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে ভিতরের এক ঘরে খাটের উপর উপুড় করিয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম -গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে”। এই গানটির কথা বিশেষ ভাবে উল্ল্যেখ করা হলো একারনে যে এটিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম কীর্তন সুরাশ্রয়ী গান হিসেবে উল্ল্যেখ করা হয়ে থাকে।
শুরুতে রবীন্দ্রনাথ কীর্তনাঙ্গের গানে আখরের ব্যবহার করেছেন । আখরযুক্ত সেই গান গুলোর মধ্যে মাঝে মাঝে তব দেখা পাই (রাগ- কীর্তন, তাল-দাদরা, রচনাকাল- ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ) বা আমি শ্রাবনে আকাশে ওই গানটির কথা আলাদা করে বলা যায় ভাবগত পার্থক্যের কারণে। এই গানগুলোর প্রথমটিতে পরম ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন যেমন আমাদের চোখে পরে তেমনি করে পরের গানটি আমি শ্রাবনে আকাশে ওই ( রাগ- সাহানা, তাল- কাহারবা, রচনাকাল ১৯৩৭) গানটির বাণী যেন একেবারেই কীর্তন গানের বাইরের। সেখানে আখরযুক্ত কির্তনের সুরের ব্যবহারকে ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথের বাণীর ভাব আমাদের আচ্ছন্ন করে তোলে। এ গানে বিরহ আন্দলিত মন এবং প্রকৃতি প্রধান হয়ে উঠেও কীর্তনের সুরের ধারার কারণে এটি তাঁর কীর্তনাঙ্গের অন্যতম উদাহরন।

কীর্তনাঙ্গের গানের বাণীর প্রসঙ্গে আর যে গানটির কথা মনে হলো সেটি একটি দেশাত্তবোধক গান। বাংলার মাটি বাংলার জল রাগ- কীর্তন , তাল- একতাল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে রচিত এই গানটি সুর কীর্তনের সুর প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও এর বাণী রবীন্দ্রনাথের দেশাত্তবোধের ধারক। এরকমই আরেকটি গান “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি” । আখর বর্জিত এ গানটির রাগ – কীর্তন, তাল- অর্ধঝাঁপ ও রচনাকাল ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ।সুরে কীর্তনের আভাস থাকলেও এখানে বাণীর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র আমাদের চোখে পড়ে।

কীর্তন গানের সুরের প্রভাব এবং বাণীর উপাদানগত মিলের দিকে যে গান গুলো সচরাচর আমাদের মনে পড়ে তাঁর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য “মরিলো মরি আমায় বাঁশীতে ডেকেছে কে” । বাঁশি, যমুনাতীর, কুঞ্জবনের কথা যেমন এই গানে রয়েছে তেমনি করে সুরের ক্ষেত্রেও রয়েছে কীর্তনের ধারার সুরের প্রভাব।

যে গানের উল্ল্যেখ করে আজকের এই অল্প আলোচনার ইতি টানতে চাই সেটি ১৯৩৩ সালে রচিত “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়” রাগ- কীর্তন, তাল- দাদরা। ঈশ্বরই গানের মূল বিষয়বস্তু কিন্তু যশোগাথা বা মহিমা প্রচারের আঙ্গিকে এখানে ঈশ্বর উপাস্থাপিত হননি, এখানে ঈশ্বর আপনি এসে ধরা দেয়া আরাধ্য যাকে হারানোর বেদনা এবং ফিরে পাবার আনন্দ দুটোই প্রবল। তাঁকে ভালবেসে অশ্রু বিসর্জন যেমন আছে তেমনি শান্ত হাসির অরুণ আলোর মত সে ঈশ্বর নয়নে ভাতিছেন।

দু’শরও বেশী কির্তনাঙ্গের গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কীর্তন গানের যে দস্তুর তাঁকে ভেঙে নির্মান করেছেন নতুন ধারা তাতে কীর্তনের সুর গিয়ে মিশেছে মার্গ সঙ্গীতের সুরে, ভগবানের মহিমা প্রচারের গান হয়ে উঠেছে পরম ঈশ্বরের বিরহ মিলনের গাঁথা কিংবা একেবারের ভিন্ন আঙ্গিকের ভাব, ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কীর্তন গান ধারন করেছে জীবনবোধ, বিশ্ব প্রকৃতি, প্রেম, ব্যক্তিমানস কিংবা স্বদেশ। প্রথা ভাঙার দৃঢ়তা রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট। কীর্তন যা কিনা এক সময়ে বটতলার , হাটেমাঠের বৈষ্ণব ঠাকুরদের গান হিসেবেই প্রচলিত ছিলো। কীর্তনের বিষয়বস্তু, ভাব ভাষা সুর সাধারনের হৃদয়ে সহজে জায়গা করে নিয়েছে বলে যা সমাজের উঁচু শ্রনীর অনাদরে ছিলো, সেই গানকেই রবীন্দ্রনাথ নিলেন বুকে তুলে। রপ্ত করেছেন কেবল তা নয় , হৃদয়স্থ করেছেন যত্নের সাথে। তারপরে নিয়মের ঘেরাটোপ ভেঙে নির্মান করেছেন নিজস্ব আঙ্গিকের কীর্তন গান বা কীর্তনাঙ্গের গান। রবীন্দ্রনাথ কির্তন গানের প্রসঙ্গে বলেছেন “বাঙালির কীর্তনগানে সাহিত্যে সংগীতে মিলে এক অপূর্ব সৃষ্টি হয়েছিল–তাকে প্রিমিটিভ এবং ফোক্ ম্যুজিক বলে উড়িয়ে দিলে চলবেনা। উচ্চ অঙ্গের কীর্তন গানের আঙ্গিক খুব জটিল ও বিচিত্র, তার তাল ব্যাপক ও দুরূহ, তার পরিসর হিন্দুস্থানী গানের চেয়ে বড়ো। তার মধ্যে যে বহুশাখায়িত নাট্যরস আছে তা হিন্দুস্থানী গানে নেই”।


লেখক পরিচিতি

ইমতিয়াজ আহমেদ
লেখক ও গবেষক


  • তথ্যসূত্র :

১. ‘জীবনস্মৃতি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ‘সঙ্গীতচিন্তা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. ‘গানের পেছনে রবীন্দ্রনাথ‘ সমীর সেনগুপ্ত
৪. ‘গানের ভেলায় বেলা অবেলায়’ অনন্ত কুমার চক্রবর্তী
৫. রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গান। স্মৃতি চট্টোপাধ্যায়


More Publications