ভাব দেহের অভেদ কীর্তন- মণিপুরী নট সংকীর্তন

আলোচ্য প্রবন্ধ বাংলাদেশের মণিপুরী জাতি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা ‘নটপালা’ বিশ্লেষণ করেছে। প্রবন্ধটি নটপালা পরিবেশন প্রক্রিয়ার অন্তঃস্রোত- বৈষ্ণবীয় ধর্ম-দর্শন, ভাব, রস, ভক্তি, বিশ্বাস কিরূপে শাস্ত্রীয় নৰ্ত্তনশৈলী (পুং চোলম ও করতাল চোলম) এবং পালা অভিনয়ের প্রথাগত পরিবেশনা-জ্ঞানের মেলবন্ধনে ক্রিয়াশীল হয়, তা অনুসন্ধান করেছে। বোঝার চেষ্টা করেছে, কী কী কৌশল এবং প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে রাধা ও কৃষ্ণ কুশীলবের এক অভিন্ন অদ্বৈত ভাব ও দেহে বা ভাব-দেহে মূর্ত হয়। মূর্তকরণের এই প্রক্রিয়ায় জীব ও পরমের পৌরাণিক সম্পর্কের শিকড় কতদূর অবধি ছড়িয়ে রয়েছে তারও একটি হদিস অনুসন্ধানের চেষ্ট রয়েছে এই প্রবন্ধে ।

মূল শব্দ : পুং-চোলম, করতাল চোলম, ভাব-দেহ, মূর্তকরণ, ভক্তি, ইশালপা, মণ্ডলী, লীলা, আত্তীকরণ।

বিবর্তনে মণিপুরী নট সংকীর্তন

বাংলাদেশের মণিপুরী (বিষ্ণুপ্রিয়া) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি সমৃদ্ধ পরিবেশনা- নট সংকীর্তন যা নটপালা নামে অধিক পরিচিত। নট সংকীর্তন মণিপুরী সমাজের অপরিহার্য সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গরূপে উঠান থেকে শ্মশান, মণ্ডপ থেকে মণ্ডলীর প্রায় সকল প্রকার ধর্মীয় ও সামাজিক কৃত্যের একটি পালনীয় অনুষ্ঠান হিসেবে প্রদর্শিত হয়। এগুলোর মধ্যে ধর্মীয় প্রসঙ্গ যেমন- রথযাত্রা, হোলি, রাখাল রাস, হরি-শয়ন, হরি-উত্থান, কৃষ্ণজন্ম প্রভৃতি এবং সামাজিক প্রসঙ্গ যেমন- বিবাহ, অন্নপ্রাশন, কর্ণবেধ, উপনয়ন, শ্রাদ্ধাদি সম্পাদন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মানত পূরণের উপায় হিসেবেও এই কীর্তনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মানতকারী পূণ্যধামে (মণ্ডলী/আসর) উপস্থিত থেকে বা আসন গ্রহণ করে পুণ্যের প্রতীকী অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পান।

যদিও নটপালা স্বতন্ত্র ও স্ব-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি পরিবেশনা রীতি, তথাপিও এর ‘বিবর্তন’ প্রসঙ্গ আলোচনায় রাসনৃত্য/লীলার উদ্ভব ও বিকাশে ঐতিহাসিক যোগসূত্রকে অস্বীকার করা যায় না। আর এই যোগসূত্রের মূলে রয়েছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের মণিপুর গমন এবং সর্বগ্রহণীয় হয়ে ওঠার গল্প। মধ্যযুগে নানা পর্ব জুড়েই চৈতন্যের ভক্ত সাধকগণদের মণিপুর গমানাগমনের খবর জানা যায়। তবে ইতিহাস বলে ‘রামনারায়ণ শিরোমণির প্রচেষ্টাতেই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম মণিপুরে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে’ (ধীরেন, ২০০৮.১১)। বলা হয়ে থাকে যে, বাংলা অঞ্চলের বৈষ্ণবীয় ধর্ম দর্শনের সংস্পর্শে আসার কারণে মণিপুরীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ব্যাপক পরিবর্তন, আত্তীকরণ এবং সমন্বয়করণ প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়। সমন্বয়ের প্রক্রিয়াটি সংগঠিত হয় মূলত দু’টি বিষয়- বৈষ্ণবীয় ভাবদর্শন এবং স্থানীয় শিল্প-আঙ্গিকের মধ্যে। অর্থাৎ- ‘It is the Vaishnava content which has been superimposed on the existing layers of artistic performance (Vatsyayan, 1976. 138). এই ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের অনিবার্য ফলস্বরূপ বেশকিছু আত্তিকৃত শিল্প-আঙ্গিক বিকশিত হয়, যেমন- রাসনৃত্য, খুপা-ঈশেই, সংকীর্তন, নটসংকীর্তন বা নটপালা প্রভৃতি। এই পুরো প্রক্রিয়াটি সংগঠিত হয়েছিল মধ্যযুগের শেষ ভাগে, যেখানে নব্য আত্তিকৃত শিল্প-রীতিগুলো নির্দিষ্ট শাস্ত্রীয় গঠন-কাঠামোয় স্বতন্ত্র ও স্বকীয় হয়ে ওঠার পথ খুঁজে পায়। স্বাভাবিকভাবেই নট সংকীর্তনসহ বিকশিত অন্য সকল শিল্প-রীতিগুলোর ধর্মীয় সমাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটিও একই ইতিহাসসূত্রে গাঁথা হয়ে যায় । ইতিহাসের দৃষ্টান্তে দেখা যায় মহারাজার ভাগ্যচন্দ্রের সময়কালেই (১৭৬৪) সৃষ্টি হয় নটপালা বা নটসংকীর্তন বা অনৌবা পালা। আবার এটিও স্বীকৃত সত্য যে, রাসনৃত্য ও নটপালা উভয়ের অন্তর্নিহিত ভাববস্তুর রূপায়ণে ‘বঙ্গদেশ পালা’ বা ‘অরিবা পালা’র (দর্শনা ঝাভেরী ও কলাবতী দেবী, ১৯৯৩. ১৫) ভূমিকা ছিল বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ থেকে গমনসূত্রে এই বঙ্গদেশ পালাটিকেই বলা হয়ে থাকে নটপালার মূল বা আদি। সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের এই পর্বেই অর্থাৎ ভাগ্যচন্দ্রের পূর্ববর্তী মহারাজা গরীব নওয়াজের সময়কালেই বঙ্গদেশ পালা মণিপুরে প্রবর্তিত হয়।

অপরদিকে রীতি ও বৈশিষ্ট্যগত সুনির্দিষ্ট পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাস উৎসবের রাস-মণ্ডলীতে বিধিবদ্ধ ক্রম অনুসারে রাসনৃত্য ও নটপালা একে অপরের পরিপূরকরূপে পরিবেশিত হয়। কেননা ‘যেকোনো রাসের পূর্বরঙ্গ হিসাবে সর্বপ্রথম নটপালা আবশ্যক’ (দর্শনা ঝাভেরী, কলাবতী দেবী, ১৯৯৩, ৩৯)। একই অভিনয় আয়তন বা রাস-মণ্ডলীতে রাসনৃত্য ও নটপালার ক্রমানুসার পরিবেশনের এই বিষয়টিকে একটি শাস্ত্রীয় শিল্প-আয়তনে অপর আরেকটি শাস্ত্রীয় শিল্পরূপের আত্তীকরণ বা সমন্বয়ের চেষ্টা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। কেননা অভিনয়রীতি অথবা পরিবেশনের প্রকৃতিগত দিক থেকে এদের পার্থক্য সুস্পষ্ট- রাসনৃত্য ‘নাটগীত রীতির’ পরিবেশনা কিন্তু নটপালা অভিনীত হয় ‘বর্ণনাত্মক্রীতি’তে (এর ব্যাখ্যা পরবর্তীতে করা হয়েছে)। রাসনৃত্যের সকল কুশীলব অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর কিশোরী কিন্তু নটপালা পূর্ণ-বয়স্ক পুরুষ কুশীলবের পরিবেশনা। রাসনৃত্যে নৃত্য-কুশীলবের বাচিক অভিনয় গৌণ গুরুত্বে বিবেচ্য। আঙ্গিক (নৃত্যাত্মক ভঙ্গি, চলন ও সঞ্চলন) ও আহার্যাভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রের রূপায়ণ সম্পন্ন হয়। বিপরীতক্রমে নটপালায় বাচিকাভিনয় এবং সাত্ত্বিকাভিনয় মুখ্য। কুশীলবগণ ক্রিয়া সম্পাদনে (রাধা, কৃষ্ণ এবং গোপী) গীত ও কাব্য উপাদান ব্যবহার করে চরিত্রের ভাব-দেহকে (পরবর্তীতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে) মূর্ত বা রূপায়ণ করেন । তথাপি দুটি মৌল সাদৃশ্য রাস-মণ্ডলীতে পরিবেশিত নটপালা এবং রাসনৃত্যকে এক ও অবিচ্ছেদ্য শিল্প কাঠামোয় সূত্রবদ্ধ করে- এক. বিষয় (রাধাকৃষ্ণ) এবং দুই. ভাব (কৃষ্ণভক্তি)। নটপালা ব্যতিত রাসের ভাব ও প্রতীকী দেবায়তন প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব। নটপালা রাস-মণ্ডলীর পূর্বরঙ্গে রাগ-আলাপ, পুংচোলম, করতাল-চোলম, গৌরাঙ্গ বন্দনা, গুরু বন্দনা, বৈষ্ণব বন্দনা প্রভৃতি কৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে প্রতীকী উপায়ে কৃষ্ণের মূর্তি স্থাপন, আসন অধিষ্ঠান, প্রাণ দান সম্পন্ন করে কৃষ্ণ-ভাবায়তন প্রতিষ্ঠা করে। অতঃপর প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণ-ভাবায়তনে, ভক্তি আবেশে পূর্ণ রাস মণ্ডলীতে প্রদর্শিত হয় রাসলীলা বা রাসনৃত্য। রাসের ‘পূর্বরঙ্গ’ হিসেবে নটপালার এইরূপ সম্পৃক্ততাকে এক মহা সাংস্কৃতিক-সমন্বয় হিসেবেও ব্যাখ্যা করার সুযোগ রয়েছে—

[সে সময়] বঙ্গদেশের কয়েকজন কীর্তনীয়া মণিপুরে এসেছিলেন। মন্দির পেয়ে তাঁরা মহা খুশী। সন্ধ্যা আরতির সময় মন্দিরে এসে তাঁরা কীর্তন করতেন। কীর্তনের সঙ্গে সঙ্গত করবার জন্য রাজা উপহার দিলেন একটি পুং অর্থাৎ মৃদঙ্গ। এই পুং তৈরি হয়েছিল রাজ দরবারের ব্যবহৃত খুনবুং বাদ্যযন্ত্র ও বাংলার মাটির খোলের সংমিশ্রণে- একটি অভিনব আবিষ্কার। কীর্তন জমে উঠলো পুং-এর সহযোগিতায় । সঙ্গে লোহার তৈরি ঘণ্টা তো ছিলই। বিষ্ণুর উপাসনার জন্য এভাবে একটি নতুন কীর্তন ধারার সূত্রপাত হলো (চলিহা, ২০০৯.৩৯)।

সুতরাং নিঃসন্দেহ থাকা যায় যে, নট সংকীর্তন এবং রাসনৃত্য একই সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সমন্বয়সূত্রে বিকশিত একে অপরের পরিপূরক অথচ দু’টি স্বতন্ত্র শিল্পরূপ। এইক্ষেত্রে নট সংকীর্তন বাংলার কীর্তনাঙ্গিকের সাথে মণিপুরের স্থানীয় শিল্পকলার মেলবন্ধনে সৃষ্টি হওয়া একটি আত্তিকৃত নতুন শিল্পরূপ। তবে আত্তিকরণের এই ফলাফল এবং এর প্রক্রিয়াকে একটি যুগের পরিসীমায় দেখলে এর বিকাশ বিবর্তনকে পূর্ণরূপে বোঝা যাবে না। বরং প্রকৃতি ও পরমের ভেদ অভেদ তত্ত্বের যে সকল প্রাচীন ও পৌরাণিক শিকড় এই চিন্তামূলে প্রথিত ছিল সেই বিষয়গুলোকেও এক্ষণে খানিকটা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন ।

ভেদ অভেদের পৌরাণিক শিকড়

মণিপুরীদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির প্রধান উপাস্য দেবতা পরমপুরুষ কৃষ্ণ। ভক্তি ও প্রেম যে উপাসনার আত্মা বা প্রাণ আর ক্রিয়াত্মক অনুষ্ঠানাদি বা সংকীর্তন যার শরীর— ‘সঙ্কীর্তন হইতে পাপ সংসার নাশন। চিত্ত শুদ্ধি সর্বভক্তি সাধন উদ্‌গম (মুখোপাধ্যায়, ১৯৯০)। তথাপি, মণিপুরীগণের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতির যে রূপ বর্তমানে পরিলক্ষিত হয়, এর গভীরে রয়েছে তিনটি ধর্মীয় স্রোতধারা ও বিধি-বিধানের সমন্বয়। মণিপুরীরা প্রধানতঃ বৈষ্ণব ধর্মানুসারী। এদের মধ্যে অনেক প্রাচীন ‘আপোকপা পন্থী’ যারা রাজা গরীব নওয়াজের আমলে শান্তিদাস গোস্বামী প্রচারিত রামানন্দী বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে নি। তবে মেইতেইদের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও বিষ্ণুপ্রিয়ারা সকলেই ধর্মত বৈষ্ণব। মণিপুরীদের বৈষ্ণব ধর্মের স্বরূপ বা মতাদর্শ স্পষ্ট না হলেও আঠারো শতকের শুরুতে শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব-মতবাদের প্রভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হতে থাকে (আহমদ, ২০১১)। সুতরাং বাংলাদেশের মণিপুরী জাতিতাত্ত্বিক নট সংকীর্তনের আলোচনায় ‘ধর্ম’- তত্ত্ব ও দর্শন প্রসঙ্গকে গৌণ-গুরুত্বে বিবেচনা করার সুযোগ নেই, বরং বলা যেতে পারে, এ জাতির ধর্ম-তত্ত্ব, দর্শন ও ক্রিয়াত্মক আচার-আনুষ্ঠানিকতার গভীরেই নিহিত রয়েছে বিশেষ এই পরিবেশনার প্রাণবায়ু। আবার এখানেই নিহিত রয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পতত্ত্ব ও দর্শনের প্রভেদ।

মানুষ যখন থেকে দেহকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিরূপ মান্য করে দেহ-অভ্যন্তরেই সাধন করেছে স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিতত্ত্ব অথবা স্রষ্টাকে খুঁজেছে নিজেরই দেহ খাঁচায় বন্দী এক অচিন পাখি (আত্মা) রূপে, সম্ভবত তখন থেকেই ভারতবাসী ‘দেহকে দেহাতীত ভাবব্যঞ্জনায় রূপান্তরিত করবার এক অত্যাবশ্যক পূর্বশতরূপে ভাবতে শিখেছিল (বাৎসায়ন, ১৯৯৫)। আর এই ভাবনার সূত্রপাত ঠিক কখন থেকে মানব মনে দানা বেঁধেছে তার সঠিক হিসেবে করা হয়তো আদৌ সম্ভব নয়, তবে বেদ, উপনিষদ, পৌরাণিক কবির দৃষ্টি ঠিকই মানব মনের এই ভাবনা সাঙ্গীকরণে ভুল করেনি—

The Vedic writer is fully conscious of the physical reality of biological man. […] Narayana, who is also the author of the Purusa-sukta (R.V.X. 90) describes vividly the organs, limbs, and parts such as the skeleton, bones, muscles, veins and arteries of the body on the cosmological plane. […] He created the earth and the bodies. [ … ] The moon was born from His mind, the sun from His eyes, from His mouth, Indra and fire, and from His breath was wind-born, the heaven, the earth from His feet, the four quarters from His ear-thus they fashioned the worlds (Vatsyayan, 1983).

অন্যত্র ঋগবেদের কিছু স্তবগাথায় দেখা যায় পরমপুরুষ (Supreme Being) স্বয়ং এক ব্রহ্মস্তম্ভ (Cosmic Pillar) হিসেবে কল্পিত হয়েছে— ‘Several hymns in the Rgveda are devoted to the Stambha or the Skambha where the Supreme Being itself is seen as a great Cosmic Pilar ( Vatsyayan, 1983). কিন্তু ব্রহ্মস্তম্ভের রূপ-কল্পনায় এই পরমপুরুষটি কে? এর ব্যাখ্যাই বা কী? এর উত্তরে অথর্ববেদ ব্রহ্মস্তম্ভের অবয়বগত যে ব্যাখ্যা প্রদান করে সে তো দেহ-অঙ্গেরই প্রতীকী গঠন—

Chapter X of the Atharvaveda reads: ‘(7) What is above, below and in the middle, that which the creator created as the universe, to what extent did this Pillar enter therein? The portion (of it) that did not enter, how much was that? (11) In which penance asserting itself, maintains the higher vow, wherein are the moral order and faith, the waters and the knowledge, tell (me) about that Pillar, who ‘is He?’ And again, ‘(32) Obeisance unto that supreme Brahman of whom earth is the footstool, the ether is the belly, and who made heaven His head. (38) The mighty adorable spirit at the centre of the world, engrossed in penance on the surface of water, on Him rest all the gods that are, even as branches round the trunk of a tree (Vatsyayan, 1983).

অথর্ববেদের এই বর্ণনা মতে ব্রহ্মাণ্ড বা ব্রহ্মপ্তম্ভের (Cosmic Pillar) মধ্যবর্তী স্তর- মহাশূন্য (the ether is the belly) বা কেন্দ্র (Central Pillar) আকাশ (Sky) এবং মর্ত্যকে (earth) সংযুক্ত করে, যা একই সাথে পরমপুরুষ ব্রহ্মার পূর্ণাঙ্গ দেহরূপের (স্তম্ভ) তিনটি স্তররূপে প্রতীকায়িত হয়েছে, যেখানে- মধ্যবর্তী স্তর বা কেন্দ্র- পেট ভূমির সাথে পায়ের এবং মাথার সাথে আকাশকে সংযুক্ত করেছে। স্বভাবতই মধ্যবর্তী স্তরে থাকবে একটি কেন্দ্র বা বিন্দু (Central), বেদ-সূত্রে এই বিন্দুকেই দেহের নাভি (navel) রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে দেহের কেন্দ্র- নাভিকেই স্তম্ভের মধ্যবর্তী অংশরূপে দেহের ঊর্ধ্বাঙ্গের সাথে নিম্নাঙ্গের; দেহের সাথে নিখিলের অথবা জীবের সাথে পরমের সংযোগ- বিন্দু হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে— ‘Again many hymns of the Vedas mention a centre which corresponds to the navel of the body. Thus, repeatedly we are told in these cosmological hymns that the stambha or the great pillar is located in the middle or the navel of the earth (Vatsyayan, 1983).

নিখিল ভুবনের বস্তুগত এবং ইন্দ্রিয়াতীত সমগ্রতায় দেহকে যুক্ত করে নানাবিধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অবয়ব-অভিব্যক্তিকে প্রতীকায়িত করার ভাবনা কেবল বেদেই ব্যাখ্যাত হয়েছে তা নয়, বরং উপনিষদও দেহাঙ্গকে যুক্ত করেছে দেহাতীত পরমের ভাবব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তির (দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক) নির্মাণ-বিনির্মাণের সূত্রে। ঐতরীয় আরণ্যক জীব (মানব) ও জগতের উৎপত্তি এবং এদের গুণাবলি একসূত্রে বর্ণনা করে— নিখিল এই ব্রহ্মাণ্ড আদিতে ছিল কেবল-ই স্ব বা আত্মা (self) রূপে এবং আত্মা থেকেই গঠিত হয়েছে মানবকুলে—

The Aitareya Upanishad II. 4.1 [ … ] in the beginning there was the self who created the waters, from which he created the Primordial Man, from whose mouth, speech, nose, smell, eye, ear heart, mind, navel and the generative organ subsequently emerged; how from these limbs and the sense organs were first created the divinities Fire, Vayu, Aditya, Quarters, Moon, Death, Waters, etc and then divinity man; how fire (agni) entered in the form of speech, air (vayu) in the form of breath, the sun (aditya) in the form of the eye, quarters (disa) in the form of the ear, the moon in the form of the mind, and how finally the highest self-entered him (Vatsyayan, 1983).

দেহভাণ্ডের (microcosm) এই যে অঙ্গরূপ সৃজন, বিভাজন এবং প্রতীকীকায়ন সে তো আত্মারূপ নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের (macrocosm) জ্ঞান অর্জনেরই নিমিত্তে— ‘আমি কে? এই দেহ তো আমি নই। দেহ নশ্বর। আত্মা অবিনশ্বর। এই আমি’র উত্তরটা উপনিষদ আমাদের শিক্ষা দেয়। ভিতরের আমিটাকে জানতে হবে। জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন এই জ্ঞানটাই “আত্মজ্ঞান” (ভট্টাচার্য, ২০১২)।’ এরূপ অভেদাত্মক বিবেচনায় আত্মজ্ঞান বা আত্মদর্শনেই যদি নিহিত থাকে মোক্ষলাভের গূঢ়-রহস্য, তবে দেহ আর আত্মার এই অদ্বৈত-ভাবনা, এ তো কেবল বৈদিক উপনিষদ বা পৌরাণিক যুগের সত্য নয়, এ তো প্রাচ্য-প্রাকৃতযুগের সত্য, পরমসত্য বৈষ্ণবদেরও—

সাধারণভাবে বলিতে গেলে বৈষ্ণবের কৃষ্ণ শাক্তের শিব, সাংখ্যের পুরুষ, আরও শিথিলভাবে বলা যায়, বজ্রযানীর বোধিচিত্ত, সহজযানীর করুণা, কালচক্রযানীর কালচক্র; আর রাধা হইতেছেন শাক্তের শক্তি, সাংখ্যের প্রকৃতি, শিথিলভাবে বজ্রযানীর নিরাত্মা, সহজযানীর শূন্যতা, কালচক্রযানীর প্রজ্ঞা। সমসাময়িক কালের এই চেতনার স্পর্শ বৈষ্ণবধর্মেও লাগিবে, ইহা কিছুই বিচিত্র নয়। পরবর্তী সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের কৃষ্ণ-রাধা যে পুরুষ প্রকৃতি ও শিব-শক্তি ধ্যান-কল্পনার এক পরিবারভুক্ত, এ সম্বন্ধে তো কোনোই সন্দেহ নাই (রায়, ১৩৫৬)।

পরমের সন্ধানে দেহ’তে ভর করা অথবা ব্রহ্মাণ্ডের তাবদ চলন ও পরিবর্তন সূত্র দেহ-অভ্যন্তরে তালাশ করার চিরন্তন প্রবণতা, সে তো কেবল দর্শন-তত্ত্ব, কাব্য-সাহিত্য (বৈদিক থকে প্রাকৃত) রচনাতেই সীমিত ছিল তা নয় বরং মানুষ সকল যুগে সকল কালেই অঙ্গীয়-সামগ্রিকতায় প্রায়োগিক অভিব্যক্তিতে প্রকাশের চেষ্টাও করেছে সমান আগ্রহে। শাস্ত্রকারগণ তাই দেহরূপ বাহির (physical realities) এবং আত্মারূপ অন্তরের (psychical realities / sences) এক ও অভিন্ন বন্ধন, আন্তঃসংযোগ ও নির্ভরশীলতায় দেহাতীত ভাবব্যঞ্জনা ও ভুবনব্যাপী-প্রপঞ্চকেই (universal phenomenon) ব্যাখ্যা করেছে কখনো দৃশ্যকাব্য, নৃত্য অথবা গীত নানা মাধ্যমে। পরমের স্বাদ (ultimate experience) পেতে চেয়েছে দূর-যাত্রা পথের বৃন্দাবনে নয়, তাঁর নিজেরই দেহরূপ-বৃন্দাবনে। এই যদি আত্মতত্ত্বের মূলকথা, তবে নাট্যশাস্ত্রকারগণই বা এই সাধনা হতে দূরে থাকবেন কেন; জীবাত্মা পরমাত্মার অভেদাত্মক সাধনা সে তো দেহ ও মনের ভাবকেই প্রতীকায়িত করা হয়েছে মানব জীবনের অর্থ ও কারণ অনুসন্ধানের নিমিত্তে যথাক্রমে নাট্য শরীর- ইতিবৃত্ত (গঠন/বিন্যাস/প্লট) এবং নাট্যের আত্মা- রসের (শিল্পী, দর্শক এবং শ্রোতার পরম আনন্দ/আস্বাদন/অভিজ্ঞতা লাভ) প্রায়োগিক ভাব/অভিব্যক্তির ব্যঞ্জনায়—

The relationship of the one and the many, the inner and the outer, the structure of multi-layering are the guiding principles of the rasa (atma) and itivrtta (sarira) (Vatsyayan, 1983).

সুতরাং দেহ এবং মনের (আত্মা) অদ্বৈত অভেদাত্মক উপস্থিতি, যা বহু নাম ও রূপ বৈচিত্র্যে প্রতীকায়িত হয়েছে যুগে যুগে- কখনো জীবাত্মা-পরমাত্মার প্রতীকে কখনো বা পুরুষ ও প্রকৃতির রূপে আবার কখনো অর্ধনারীশ্বর বা রাধাকৃষ্ণের অবয়বে। অভিন্ন দেহ এবং আত্মা অথবা দেহপিণ্ড-বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অভেদাত্মক সম্পর্কের এই পৌরাণিক ও প্রায়োগিক পরম্পরায় বিকশিত শিল্পচৈতন্য- বৈষ্ণব ধর্ম দর্শন দ্বারা প্লাবিত হয় মধ্যযুগের বৃহৎ বাংলা। পার্শ্ববর্তী আসাম ত্রিপুরা এমনকি মণিপুরও এই সর্বপ্লাবন থেকে রেহাই পায় না কিছুতেই। মণিপুরী নট সংকীর্তন এই বৈষ্ণব সাংস্কৃতিক প্লাবনের ফলাফল- একটি নয়া শিল্পরূপ।

গঠন-কাঠামো

কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গলের মণিপুরী (বিষ্ণুপ্রিয়া) সম্প্রদায়ের নট সংকীর্তনের উপস্থাপন রীতিটি বর্ণনাত্মক। যদিও মধ্যযুগের জনপ্রিয় নাটগীত লিপি— বড়ু চণ্ডীদাসের (১৩৭০-১৪৩৩) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ত্রি-চরিত্রের ধারা অনুসরণে এ নটপালার আখ্যান বিন্যস্ত। তথাপিও এই কীর্তন নাটগীত রীতিকে অনুসরণ করেনি। বরং এর আখ্যান মধ্যযুগের ‘কথানাট্যের ধারায় বিকশিত কীর্তন আঙ্গিকের বর্ণনাত্মক অভিনয়ের রীতি ও বৈশিষ্ট্যকেই অনুসরণ করে। যদিও সংলাপাত্মক অংশগ্রহণ বিদ্যমান তথাপি আখ্যান উপস্থাপনের মূল সূরটি বর্ণনাত্মক। তবে এই সংকীর্তন মণিপুরীদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানাদির অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলেও এর গঠন-কাঠামো এবং প্রদর্শনে রয়েছে শাস্ত্র নির্দেশিত বিধান ও ক্রমানুসার। দু’টি ভিন্ন পরিবেশনা শৈলীর সমন্বিত গঠন-কাঠামোয় বিন্যস্ত এই কীর্তনে রয়েছে শাস্ত্রীয় নর্তন প্রদর্শন- পুং চলম, করতাল চলম এবং গীত কাব্যের বর্ণনা ও সংলাপে কৃষ্ণলীলার আখ্যান প্রদর্শন। এই দুটি স্ব-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিল্প-শৈলীর সমন্বয় এবং বিন্যাস সূত্রেই পরিবেশিত হয় নটপালার কৃষ্ণ আখ্যান।


পূর্বরঙ্গ

ব্রাহ্মণ পর্ব
যে আসরে সংকীর্তন পরিবেশিত হয় সেটা প্রতীকী অর্থে বৃন্দাবনধাম রূপে গণ্য হয়। ব্রাহ্মণ ঠাকুর তাঁর মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে বৃন্দাবনধামকে পরিশুদ্ধ করেন। পরিশুদ্ধকরণের পর শুরু হয় নট সংকীর্তন, যার ক্রমগুলো এইরূপ —
গৌরচন্দ্র : গৌরচন্দ্র অর্থাৎ গৌরাঙ্গকে বন্দনা করা। জীবের প্রতিনিধি হিসেবে গৌরাঙ্গ আশ্রিত হন। গৌরচন্দ্রিকা রাগ দিয়ে শুরু হয়। রাগটি নব অক্ষরের— তা রে তা না রে তা না তা না- এই রাগ মানে মূর্তি স্থাপন। রাগের মাধ্যমে মূর্তি স্থাপন করা হয়।
বেড়িঘাঁটু (পরিক্রমণ) : আসরে গুরুর আশ্রিত হওয়া ‘বন্দে শ্রীগুরুর পদচরণ, কোমল মম শিক্ষাগুরু’, এটা বলে গুরু আশ্রিত হন।
অবতার : গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর অবতার সম্বন্ধে গীত পরিবেশনা। গৌরাঙ্গ যিনি রাধা প্রেমে ঋণী। এই ঋণ হচ্ছে তিনটি— ভাব, কান্তি ও বিলাস। তিনটি ঋণ পরিশোধ করার জন্যই তিনি (কৃষ্ণ) গৌরাঙ্গ অবতার হয়ে মনুষ্যরূপে মর্ত্যে আগমন করেন। কৃষ্ণ লাভে রাধার তীব্র বাসনা/আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে ‘ভাব’। গো দোহন কালে শ্রীমতি রাধার রূপ দর্শনের জন্য শ্রীকৃষ্ণের যে তীব্র ব্যাকুলতা, এটিই হলো ‘কান্তি’৷ এবং বিলাস’ হচ্ছে বৃন্দাবনের রাসলীলায় শত ব্রজ-গোপী নিয়ে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমই হলো বিলাস ।
তিন তালি বা তিন তাল : তিনটি বাঞ্ছা (ভাব, কান্তি ও বিলাস) পূরণার্থে যে গীত পরিবেশন হয় তাকে তিন তাল বলে।
মেল : ভক্তের সাথে আনন্দ মিলন। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর পূর্ণরূপ- মূর্তি ধারণ ও লীলা সম্পাদন করে ভক্তের সাথে তাঁর আনন্দ মিলন করা- এটিই হচ্ছে মেল।
মণ্ডলীবিচার : পঞ্চতত্ত্ব— নিত্যানন্দের (গৌরাঙ্গের বড় ভাই) ভাব নিয়ে আসর উপবেশন করা।

এই সকল আধ্যাত্ম আনুষ্ঠানিকতায় সমাপ্ত হয় নটপালার পূর্বরঙ্গ। শাস্ত্রীয় বিধান দৃষ্টে নটপালার পূর্বরঙ্গকে জীবের সাথে পরমের মিলন-কীর্তনের প্রস্তুতি-রঙ্গ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। মহা-মিলনের এই প্রস্তুতি-রঙ্গ শুধুমাত্র শাস্ত্র পাঠে নয়, কেবল উচ্চারিত বাণীতেও নয়, বরং গীত, কাব্য, সুর, তাল, লয় আর নৃত্য ছন্দের তুমুল আহ্বানে অতঃপর মণ্ডলীতে অধিষ্ঠিত হন স্বয়ং কৃষ্ণ।

মুখোমুখি দাঁড়ান ভক্তের, পূর্ণ হয় আকাঙ্ক্ষার, আস্বাদিত হয় কৃষ্ণ মহাভাবের। বলা যায় পূর্বরঙ্গের এই সকল কৃত্যমূলক আনুষ্ঠানিকতাই আসরে দেবতা অধিষ্ঠানের বিষয়টিকে ভক্তের ভাব ও বিশ্বাসকে নিশ্চিতরূপে সম্ভব করে তোলে। কেননা—

The cosmology given in the Purana is the devotiee”s experience of the outer universe, which is interiorized in the text of the hymn. Thus the hymn is an integral part of the Puranic narrative and not extraneous to it at all. The Kirtana is therefore functional in the specific context of the narrative. The Purana is Kirtana writ large (Paniker, 2003. 37).

আখ্যান পর্ব

পূর্বরঙ্গের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পরিবেশিত হয় রাধাকৃষ্ণের লীলাময় আখ্যান বা পালা। আলোচ্য নটপালাটি দিনের চার প্রহর, অর্থাৎ প্রাতঃ, পূর্বাহ্ণ, মধ্যাহ্ন এবং অপরাহ্ণের লীলার পর্যবেক্ষণসূত্রে বিশ্লেষিত। নিম্নে চার প্রহরের কৃষ্ণলীলার সংক্ষিপ্তসার বর্ণিত হলো : প্রাতঃ : “প্রাতঃকালে নন্দরাণী কৃষ্ণ জাগাইলা, উঠি কৃষ্ণ প্রাতঃকৃত শুভ সমাধিলা॥ সখা সঙ্গে গৃহাঙ্গনে খেলা আরম্ভিল, গোপাল হেরিয়া রাণী আনন্দিত ভেল৷” কৃষ্ণের প্রাতঃকালীন লীলা বর্ণনা করা হয় এই প্রহরে। প্রাতঃ রাসে মূলত বাৎসল্য প্রেমের প্রকাশ পায় । মায়ের সাথে কৃষ্ণের সকল লীলা বাৎসল্য ভাবে নিষ্পত্তি হয় ।

পূর্বাহ্ণ : গোষ্ঠ লীলা । কৃষ্ণের সখাদের অনুরোধে গহিন বনে গো-চারণে যেতে মায়ের অনুমতি গ্রহণের লীলাখ্যান। ভাই বলরামের মধ্যস্থতায় অবশেষে মা কৃষ্ণকে গো-চারণের অনুমতি প্রদান করে। লীলার এই অংশ সখ্য ভাবে নিষ্পত্তি হয়। মধ্যাহ্ন : “প্রিয় সখি ললিতে, জ্বালার উপরে দ্বিগুণ জ্বালা বন্ধু প্রেমানলে৷ কৃষ্ণ প্রেমানলে শ্যাম প্রেমানলের জ্বালা, প্রিয় সখি ললিতে৷” বনবিলাসে অভিসার ও আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল রাধা কৃষ্ণের যুগল-মিলনের লীলাময় আখ্যান বর্ণিত হয় এই পর্বে। এই পর্বের লীলাখ্যানে মধুর ভাব নিষ্পত্তি হয়।

অপরাহ্ণ : স্ব স্ব গৃহে গমনের পালা। “ভোজন শয়ন সারি, পাশা ক্রীড়া শুখসারি অপরাহ্ণে দিবা শেষে, কৃষ্ণ গোষ্ঠ পরবেশে” গোটস্থানে সূর্যপূজা শেষে প্রসাদ ভোজন করে, গৃহ গমনের উদ্দ্যেগ করে। বনবিলাস শেষে “এথা রাধা সখি সহিত, আইলা আপন গৃহে। উপহার করি কৈল স্নান, তবে নানা বেশ পরি, চড়ি অট্টালিকা উপরি, কৃষ্ণ গেল আপন গৃহ৷ তবে কৃষ্ণ একত্র করি গোধন, সখা সঙ্গে করি গৃহে করে আগমন৷ পথে রাই সুদর্শন হলো আনন্দময়, চলি আইলা আপন ভুবন। যশমতি কৃষ্ণ পাইয়া, নিরিখিয়া নিশিয়া লইল রমাকানুন।” এই পর্বের লীলাখ্যানে উজ্জল্য ভাব নিষ্পত্তি হয়। চাঁদ মুখি অতঃপর সমাপ্ত হয় দিনের চার প্রহরের রাধাকৃষ্ণের লীলাময় আখ্যান। আখ্যান অন্তেও রয়েছে কৃত্যমূলক পরিবেশনা- মৃদঙ্গ এবং করতাল বাদ্যের তুমল নৰ্ত্তন, ফাগুখেলা, ফলশ্রুতি বর্ণনা প্রভৃতি।

শিক্ষণ প্রশিক্ষণে নট সংকীর্তন

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মণিপুরী নটপালা দু’টি শিল্পরীতির মিলিত সমন্বিত পরিবেশনা। এই শিল্পরীতি দুটির একদিকে রয়েছে শাস্ত্রীয় চোলোম বা নৰ্ত্তন। চোলম বা নর্তনের আবার রয়েছে দুটি রূপ- পুংচোলম ও করতাল- চোলম। একদল সুদক্ষ বাদকের রাগ, তাল, সুর ও ছন্দের আশ্রয়ে পরিবেশিত হয় এ দুটি শাস্ত্রীয় চোলোম/নর্তন। এবং অপরদিকে রয়েছে প্রথাগত গায়েন/ ইশালপা, সহযোগী গায়েন এবং দোহার। এঁরা বর্ণনাত্মক অভিনয়-রীতিতে কৃষ্ণ আখ্যান পরিবেশন করেন।

পুংচোলম হচ্ছে পুং বা মৃদঙ্গের তালে তালে পুং-বাদকগণের প্রদর্শিত বিশেষ নর্তন এবং করতাল বাদকগণের নৃত্যযোগে প্রদর্শিত করতাল বাদন হচ্ছে করতাল-চোলম। বিশেষ এই দুটি চোলোম বা নৰ্ত্তনে প্রদর্শিত দেহভঙ্গি, চলন ও সঞ্চলনে রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু বিধান। শাস্ত্র নির্দেশিত বিধান অনুসারে নৃতযোগেই অতঃপর প্রদর্শিত হয় সুবিন্যস্ত ও কাঠামোবদ্ধ পুংচোলম ও করতাল-চোলম । শিক্ষার্থী/শিষ্যগণ এই দুটি নর্তনেরই প্রয়োগিক দক্ষতা অর্জন করেন গুরুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও দীর্ঘ প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

উল্লেখ্য যে, পুংচোলম এবং করতাল-চোলম বা নর্তনে গায়েন ও দোহার অংশগ্রহণ করেন না। একই ভাবে পূর্বরঙ্গ এবং আখ্যানের নির্ধারিত অংশ ব্যতীত পুংচোলম এবং করতাল-চোলম প্রদর্শিত হয় না। পুংচোলম এবং করতাল-চোলম নির্ধারিত কিছু ভঙ্গি, চলন ও সঞ্চলন দ্বারা বিন্যস্ত হলেও উভয় নর্ত্তনে শিল্পী-দেহের মৌল অবস্থান বা দাঁড়ানোর ভঙ্গি প্রায় এক । এই ভঙ্গিতে পায়ের গোড়ালি প্রায় এক বিঘৎ ফাঁকা রেখে ইংরেজি ‘ভি’ আকৃতিতে হাঁটু খানিকটা বেন্ট বা বক্র অবস্থায় মেরুদণ্ড সোজা তবে খানিকটা সম্মুখাবর্তী ঝুঁকে থাকে। চোলোমের শুরুতে মৃদঙ্গ এবং করতালের সম্মিলিত বাদ্যের তালে কুশীলবগণের প্রাথমিক দেহ-ছন্দ মৃদু দোলাময় হয়ে ওঠে। পর্যায়ক্রমে ডান পায়ে ভর পরিবর্তন করে ডান দিকে এবং বাম পায়ে ওপর ভর দিয়ে বামদিকে এভাবে গোটা শরীরকে ডান থেকে বাম আবর্তনে দোলানো বা দোলাময় করে রাখা। অতঃপর রাগ, তাল, লয়ে বিধি অনুসারে দেহ সঞ্চলনে ক্রমান্বয়ে অন্যান্য ভঙ্গি ও চলন প্রযুক্ত হতে থাকে।

পুং এবং করতাল বাদকগণের নর্ত্তনে- দেহভঙ্গিতে চার ধরনের ভঙ্গি ও সঞ্চলন পরিলক্ষিত হয়। এক. বক্র হাঁটুতে যথাক্রমে ডান পায়ের কৌণিক পদক্ষেপে যন্ত্র বাদন। দুই. ডান পায়ের সম্মুখ পদক্ষেপে আগমন এবং পশ্চাৎ-পদক্ষেপে পূর্বের অবস্থানে গমন গতিতে যন্ত্র বাদন, তিন. পর্যায়ক্রমে দুই পায়ের ওপর ভর ও ভারসাম্য বজায় রেখে ঘড়ির কাঁটার অনুবর্তী এবং উল্টো দিকে ঘূর্ণন গতিতে যন্ত্র বাদন, এবং চার. এক পায়ের বক্র হাঁটুতে অবস্থান করে অপর পা’কে ভূমি থেকে উপরে নব্বই ডিগ্রি কোণে বক্র অবস্থায় দেহের সচল-স্থিতি বজায় রেখে সঞ্চালন গতিতে যন্ত্র বাদন ও নৰ্ত্তন প্রদর্শন করা। তবে করতাল-চোলমের গতি সঞ্চলনে একটি অতিরিক্ত ভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়— এক পায়ের ওপর ভর ও ভারসাম্য স্থীর রেখে অপর পা’কে নব্বই ডিগ্রি কোণে বক্র অবস্থায় শূন্যে রেখে ঘূর্ণন গতিতে করতাল বাদন প্রদর্শন করা।

মণিপুরী নর্তন গ্রন্থে পুংচোলম এবং করতাল-চোলমের ভঙ্গি ও চলন সমূহকে বিভিন্ন নামে প্রতীকায়িত করা হয়েছে। যেমন- কুশীলবের দাঁড়ানোর ভঙ্গিকে ‘স্থানক’ বা ‘ফিরেক’ নামে অভিহিত করে পুংচলোমের ক্ষেত্রে তিন ধরনের ভঙ্গির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে— এক. থোংখোং আওয়াঙবা পায়ে গোড়ালির মধ্যে এক বিঘৎ ফাঁক রেখে এবং দক্ষিণ অর্থাৎ ডান-পা’কে ত্রস্ত্র অবস্থায় কিছুটা নামিয়ে রাখতে হবে। দুই. থোংখোং ময়ায় দুটি পায়ের মধ্যে বেশি ফাঁক রেখে দুই জানুর উপর দুই হাতের মণিবন্ধ যাতে রাখা যায়, ততটা নিচু হওয়া। এবং তিন. থোংখোং অনেম্বা- দুই পায়ের মধ্যে ওই ধরনের ফাঁক রেখে কনুই জানুতে লাগার মতো নিচু হওয়া। পুংচোলম এবং করতাল-চোলমের ভঙ্গি যেমন নির্ধারিত তেমনি বাদ্যের তাল এবং রাগসমূহও নির্দিষ্ট থাকে। যেমন: নটরাগ- বোল বিশিষ্ট প্রবন্ধ। সঞ্চার— বোল বিশিষ্ট প্রবন্ধ। এর দ্বারা মণ্ডলীতে কৃষ্ণ মূর্তির প্রতীকী প্রাণ দান করা হয়। তিনতাল— আট বর্ণকাল অথবা সাত বর্ণকাল। তিন তালি বা তাল হচ্ছে তিনটি বাঞ্ছা পূরণার্থে পরিবেশিত যে গীত তাকে তিন তাল বলে; রাজমেল সাত/চৌদ্দ বর্ণকাল প্রভৃতি তাল এবং রাগ ব্যবহৃত হয়।

ভাব-দেহের কীর্তন

নটপালার গায়েন বা ইশালপা এবং সহযোগী গায়েনের নৃতদেহ-ছন্দে শাস্ত্রীয় চোলম বা নর্তনের প্রয়োগ না থাকলেও চরিত্রের (রাধা, কৃষ্ণ, সখা/সখি) রূপায়ণে শাস্ত্রের শাসন সুস্পষ্ট। আর এটাই নটপালার অভিনয় ক্রিয়াকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে। চরিত্রের নির্মাণ ও রূপায়ণ ক্রিয়ায় ইশালপা’র দেহ-ক্যানভাসে রাধা ও কৃষ্ণ বিশিষ্ট কোনো মানবাকৃতিতে বা দেহভঙ্গিতে মূর্ত হয় না। যদিও রাধা কৃষ্ণের যুগলরূপের পৌরাণিক ও প্রচলিত ইমেজ, যেমন— ‘বংশী হাতে কৃষ্ণ’, ‘রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি’, ‘বালক কৃষ্ণ’ প্রভৃতি কতিপয় জনপ্রিয় ইমেজ দেহের ভাষায় মূর্ত হয় কখনো কখনো। তথাপিও নটপালার গায়েন কর্তৃক রাধা ও কৃষ্ণকে নির্মাণ/প্রদর্শন বা রূপায়ণের মৌল-প্রবণতা দেহের বিশিষ্ট কোনো ভাষা বা ভঙ্গি প্রকাশে নয়, ভাবের প্রকাশে বা ভাব দ্বারা হয় মূর্ত। অর্থাৎ রাধা-কৃষ্ণ দেহরূপে নয়, কোমল শৌর্য ও ছন্দের দোলায় ভাবরূপে বা ভাবের রূপায়ণে মূর্ত হয় দেহের ক্যানভাসে। ফলে সার্বিকভাবে গায়েনের দেহের রূপ ও ভঙ্গির প্রকাশ হয় ভাব-অভিব্যক্তিমূলক, যা ভগবান কৃষ্ণের প্রতি সমর্পিত এবং ভক্তিভাবে পরিপূর্ণ ।

ভাব দ্বারা মূর্ত করণের এই বিষয়টিকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়। যার ভিত্তিমূল হলো বৈষ্ণবীয় ধর্ম-দর্শন এবং নটপালার কুশীলবগণের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি । কেননা নটপালার উদ্দেশ্যই হলো ভক্ত মাঝে কৃষ্ণ মহাভাবের সঞ্চার করা। যা পবিত্র ও পরমানন্দীয় আবেশ দ্বারা হয় উদ্দীপ্ত অথচ ভক্তিতে তা বিনম্র। এমন কি পুংচোলম ও করতাল-চোলমের কোনো অংশের শৌর্যরূপ তাণ্ডবময় হলেও গায়েনের ক্ষেত্রে তা হয় ‘লাস্যময়-তাণ্ডব (দাস, ২০১৫), অর্থাৎ শ্রোদ্ধাবনত। পরিণামে নটপালার আসরে গায়েনের শারীরিক উপস্থিতির সার্বক্ষণিক ভঙ্গিটি রূপান্তরিত হয় কোমল ছন্দের দোলায় ভাব-ভক্তিতে পূর্ণ এক প্রাণবন্ত ছন্দময় শরীরে— ‘এইটাই হলো ভাব। এটাই হলো গুরুর নিকট হতে পাওয়া আশ্রয়। সেই আশ্রয়ে ভাবের দ্বারা, সাধন দ্বারা এখানে (আসরে) উপস্থিত। সবকিছু ভাবে বন্দী, ভাবের উপর দাঁড়িয়ে আছে, ভাবটা এদের (কুশীলব) শরীরে, সুরে, ছন্দে আসে এবং আমাদের (দর্শক/ভক্ত) শরীরে সঞ্চারিত হয় (সিংহ র.গ., ২০১৫)।

নটপালার আসরে আখ্যান পরিবেশনায় ভাবের এইরূপ সর্বব্যাপী এবং সর্বাত্মক প্রকাশের ব্যাপারটিও শিক্ষণ প্রক্রিয়ার অন্তর্গত একটি বিষয়। যা পরম্পরাগতভাবে গুরু-শিষ্যের বোঝাপড়াসূত্রে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের শরীরে ‘পরিবেশনা-জ্ঞান’ রূপে সঞ্চারিত হয়। এই শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় কৃষ্ণ স্বয়ং একটি ‘ভাব’, যা ‘কৃষ্ণ-ভাব’ রূপে চর্চিত এবং প্রদর্শিত হয়। কেননা বৈষ্ণব দর্শনে শৃঙ্গারের স্থায়ীভাব কৃষ্ণরতি। ভক্তিই শৃঙ্গার রসরাজকে শ্রীমণ্ডিত করে— ‘ভক্তিই রস। রসের আস্বাদনেই আনন্দ। আনন্দই ব্রহ্ম’ (মুখোপাধ্যায়, ১৯৯০, ৫২)। শ্রীরূপগোস্বামী প্রণীত উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থে ভক্তি রসের ব্যাখ্যায় বলা হয় —

(মধুর ভক্তিরসরাজ লক্ষণ যথা) বক্ষ্যমাণ বিভাব, অনুভাব, সাত্ত্বিক এবং সঞ্চারি প্রভৃতি কার্য্য কারণ সহকারি ভাব দ্বারা মধুরা আস্বাদনীয় হইলে পণ্ডিতেরা তাহাকেই মধুরাখ্য ভক্তিরস বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন৷ (বিভাব যথা) রতিবিষয়ক আস্বাদনের হেতুকে বিভাব বলে। ঐ বিভাব দুই প্রকার সালম্বন ও উদ্দীপন। সেই উদ্দীপন আবার দুই প্রকার হয়, কৃষ্ণ এবং ভক্ত অর্থাৎ কৃষ্ণ বিষয়ক উদ্দীপন এবং ভক্ত বিষয়ক উদ্দীপন॥( রূপগোস্বামী, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ, ৫)

শাস্ত্রের এই বিধান থেকে আরও স্পষ্ট হওয়া গেলো যে, দেহের বিশিষ্ট রূপ বা ভঙ্গির নির্মাণ গুণে নয়, সত্ত্বের সহজাত অনুভবে বা সাত্ত্বিক যুক্ত কার্য দ্বারা মধুরাখ্য ভক্তির রসাস্বাদনেই ব্রহ্মানন্দ লাভের মুখ্য উপায়। তাই রাধা বা কৃষ্ণের দেহরূপ মূর্তকরণ ব্যাপারটি নির্দিষ্ট/বিশিষ্ট কোনো দেহের ভঙ্গি নির্মাণ বা চলন কেন্দ্রিক না হয়ে ভাব-অভিব্যক্তি নির্ভর হয়ে ওঠে। ফলে রাধাকৃষ্ণ অদ্বৈতরূপে মূর্ত হয় গায়েনের ভাব-দেহে; বিশেষ ভাব-রূপে ঠিকই, তবে মানব-দেহরূপে নয়।

রাধাকৃষ্ণ ভাব-দেহে মূর্ত হওয়ার বিষয়টি নির্দিষ্ট একটি প্রক্রিয়ায় সম্পাদিত হয়। প্রক্রিয়াটি কৃত্যমূলক, যার প্রারম্ভ পূর্বরঙ্গের রাগ হচ্ছে— আত্মা। গৌরচন্দ্রিকার শুরুতে একটি রাগ গাওয়া হয় বা রাগ দিয়ে শুরু করতে হয়। এই রাগটি নব অক্ষরের গৌরচন্দ্রিকা অংশে (পূর্বেই আলোচিত)। এই অংশ থেকেই শাস্ত্রীয় রাগ ও তালের আশ্রয়ে কৃষ্ণের প্রতীকী মূর্তি বিনির্মিত হয়—

রাগ হচ্ছে— আত্মা। গৌরচন্দ্রিকার শুরুতে একটি রাগ গাওয়া হয় বা রাগ দিয়ে শুরু করতে হয়। এই রাগটি নব অক্ষরের গৌরচন্দ্রিকা অংশে (পূর্বেই আলোচিত)। এই অংশ থেকেই শাস্ত্রীয় রাগ ও তালের আশ্রয়ে কৃষ্ণের প্রতীকী মূর্তি বিনির্মিত হয় তা, রে, তা, না, রে, তা, না, তা, না ॥ এই রাগ মানে মূর্তি স্থাপন। রাগের মাধ্যমে মূর্তি স্থাপন করা হয়। প্রতিটি অক্ষরের ভিন্ন ভিন্ন মানে থাকে/অর্থ থাকে, যে অর্থের মাধ্যমে মূর্তিটি নিরূপিত হয়, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার হাত পা মাথা শরীরের সকল অঙ্গ সৃজিত হলো বা আকৃতি দেওয়া হলো। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ/উপাঙ্গ সবকিছুই ঐ রাগ-তালে বোলে- মন্ত্রদ্বারা নিরূপণ করা হয়। যখন রাগের শেষ ঠিক তখনই সম্পূর্ণ মূর্তি তৈরি বা নিরূপণ হয়ে গেল— অর্থাৎ কল্পনায় দেবতা/গৌরাঙ্গ/কৃষ্ণের অবয়ব গঠন করা হয়ে গেল। এটাকে বলে রাগালাপে মূর্তি স্থাপন (সিংহ, ২০১৫)।

রাগ-আলাপে মূর্তি স্থাপন ক্রিয়াটি প্রতীকী। এই প্রক্রিয়াসূত্রেই দেবতা ব্রহ্মা- বিষ্ণু— কৃষ্ণ— গৌরাঙ্গের বিমূর্তরূপ মর্ত্যে মানবের ভাব দেহে অধিষ্ঠিত হয় বা মূর্ত হয়। প্রক্রিয়াটিকে একদিকে যেমন প্রকৃতি ও পরমের প্রতীকী মিলন রূপে ব্যাখ্যা করা যায়। কেননা এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভক্তগণ পরমের সাথে প্রতীকী মিলন অভিজ্ঞতার স্বাদ আস্বাদন করে থাকেন। অপরদিকে মূর্তকরণের এই প্রক্রিয়াতেই গায়েন/দোহার কৃষ্ণের কল্পিত ভাব-আকৃতি বা ভাব-দেহকে দেহের ভাষায় কোমল ছন্দে ভক্তি-ভাবে রূপায়ণ করেন।

ফলে এই প্রক্রিয়ায় রাধা-কৃষ্ণের অবয়ব নির্মাণের বিষয়টি কৌশলগত বাহ্যিক আচরণে বা দেহভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠিত নয়। এমনকি গায়েনের কণ্ঠের ধ্বনিগত অলংকরণে বা শৌর্যের বিন্যাসেও রাধা এবং কৃষ্ণ চরিত্রদ্বয় পৃথক ও স্বতন্ত্র মডেলরূপে বিনির্মিত / প্রদর্শিত হয় না। ফলে সামগ্রিকভাবে মূর্তি নির্মাণের এই প্রক্রিয়ায় গায়েন তাঁর দেহে দৈনন্দিন-অতিরিক্ত এমন এক ভাবোদ্দীপক ব্যক্তিত্ব আরোপ করেন বা গায়েন নিজের ওপর আরোপ করতে সক্ষম হন, যা অচিরেই ভক্ত মাঝে মহা-পবিত্রতম ও পূজনীয় ব্যক্তিত্বরূপে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। যার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে নটপালার আসরে ভক্তের প্রতিক্রিয়ায়। এ সময়ে ভক্তদের কেউ কেউ গায়েনকেই গৌরাঙ্গের অবতার জ্ঞান করে। ভাবাবেগের তাড়নায় গৌরাঙ্গরূপে মূর্ত হওয়া গায়েনকেই করে প্রণাম। একটুখানি আশীর্বাদ ধন্য হতে অবনত মস্তক হয় ঐ গায়েনেরই সম্মুখে। অন্যদিকে মূর্তি নির্মাণের এই প্রক্রিয়া বিষয়ে নটপালার গায়েনদের উপলব্ধিও এমন যে— ‘বাদ্যযন্ত্র মৃদঙ্গ-করতালের মাধ্যমে সম্পূর্ণত গৌর গুরুমূর্তি তৈরি করা হয় দেহের ভিতরে। এই মূর্তি আমাদের মধ্যে থেকেই এই সংকীর্তন করে।’

তাই নটপালার গায়েন স্বয়ং রাধাকৃষ্ণের অভিন্ন আত্মা রূপে মূর্তমান এক পরম ব্যক্তিত্বরূপে ভক্ত অভিমুখে হাজির হন। নটপালার প্রদর্শনে তাই ভাবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতটা গভীর তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। ক্ষেত্র-সমীক্ষা কালে নটপালা প্রসঙ্গে ধারণকৃত রাসধারী গোপীমোহন সিংহের আলাপচারিতার চুম্বক অংশ উদ্ধৃত করা হলো—

প্রশ্ন : ভাব কী?
উত্তর : ভাব বলতে রাধা আয়নঘোষের স্ত্রী হয়ে, আয়নঘোষের ঘরে থেকেও কেবলই এই আকাঙ্ক্ষা যে আমি কৃষ্ণকে কবে পাবো। কৃষ্ণ লাভে রাধার এই যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা এটিই ভাব। অর্থাৎ কৃষ্ণ দর্শন লাভের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা এটাই হলো ভাব বা কৃষ্ণ-ভাব।

প্রশ্ন : রাধার উৎপত্তি কোথায়?
উত্তর : রাধার উৎপত্তি কৃষ্ণের স্থায়ী ভাব হইতে। রাধা-কৃষ্ণ একাত্মা, শুধু লীলার কারণে, আমাদের শিক্ষা দেওয়ার কারণে ওদের ভিন্ন রূপ ।

প্রশ্ন : কোন ভাবটা প্রাধান্য পায়, রাধা-ভাব নাকি কৃষ্ণ-ভাব ?
উত্তর : ভাব তো আমার একটাই, রাধা-কৃষ্ণ আমার কাছে তো ভিন্ন না, ও তো এক আত্মা ।

প্রশ্ন : কী উপায়ে ভাবে এত মগ্ন হতে পারেন?
উত্তর : ট্রায়েল দিতে হবে অর্থাৎ গুরুগৃহে শিক্ষা করতে হবে। সাধন করতে হবে, যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেনো, সেই সম্প্রদায়ের নিয়মানুসারে সাধন করতে হবে। গুরুর নিকট হইতে গূঢ় তত্ত্ব আয়ত্ত করে অতঃপর নিজে নিজে ট্রায়েল না দিলে, অথবা নিজেকে সর্বদাই সাধনে রত থাকতে হবে।

প্রশ্ন : আসরের উপস্থিত হওয়ার পূর্বে আপনি অতি সাধারণ ও শান্ত একটি মানুষ। কিন্তু আসরে দাঁড়ালে বিশেষ এক শক্তি আপনার দেহকে উদ্দীপ্ত করে, কেন?
এইটাই হলো ভাব, আমাদের যেটা সাধন বা ভজন, সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করতে হলে, যে শ্রেষ্ঠ পন্থা, বিভিন্ন পন্থা আছে, আমাদের বৈষ্ণবীয় মতে- এই যে আমাদের অষ্টকাল, এখানে আমরা যেটা বর্ণনা করেছি (পর্যবেক্ষণকৃত নটপালা) এটা চার কাল। এই অষ্টকালটাই আমাদের মূল সাধনের পথ। এবং সেখানে আমাদের মূল ভাবটা- ঐ যে বললাম না নিষ্কাম প্রেম, এটিই আমাদের মূল ধারা, কেউ যদি এটাকে স্বকাম মনোভাব দ্বারা একটু মনে আনে তাহলেও তার নরকবাস। ঐ ভাবে যদি কেউ যেতে পারে, তাহলে তার অন্তর বিগলিত হবে, তখন সে মূল সাধন অঙ্গে প্রবেশ করতে পারবে। এটাই আমাদের গুরু শিক্ষা এই পথ অনুসরণ করে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব (সিংহ র.গ., ২০১৫)।

উদ্ধৃত সাক্ষাৎকার দৃষ্টে স্পষ্টতই বলা যায় যে, ‘ভাব’ হচ্ছে নটপালার সেই প্রাণশক্তি যা আসর থেকে আসরে ভক্ত মাঝে ছড়িয়ে দেয় কৃষ্ণ-ভক্তির রসধারা। তবে কুশীলবগণ যে কেবলই কৃষ্ণ-ভক্তির রসধারায় অবগাহন করে অনিয়ন্ত্রিত ভাব-স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেন বিষয়টি তাও নয়। শাস্ত্রীয় রাগ, তাল, সুর, ছন্দ এবং দেহের শৈলীবদ্ধ চলন, সঞ্চলন ও ভঙ্গির বন্ধনে ঐ ভাব-স্রোতকে করেন নিয়ন্ত্রিত, নিবেদিত সর্বোপরি শিল্পিত। এভাবেই নটপালার সামগ্রিক শিল্প কাঠামোটি শাস্ত্রীয় নৰ্ত্তন-শৈলী (পুং চোলম ও করতাল চোলম) এবং শাস্ত্রীয় ভাব ও ভক্তিতে কৃষ্ণ-আখ্যান প্রদর্শনী- এই দুই ধরনের পরিবেশনার সন্ধিবদ্ধ এবং সমন্বিত এক শিল্পরূপ হয়ে ওঠে।। এরূপ সন্ধিবদ্ধ উপস্থাপনাতেই অতঃপর রাধা ও কৃষ্ণ এক দেহে, এক ও অভিন্ন আত্মাতে হয় মূর্ত। সুতরাং পৃথক-রূপে নয় বরং বিনম্র ভক্তিতে নিবেদনের তরে অভিন্ন রাধা-কৃষ্ণের ‘ভাব-দেহ মূর্তকরণ’ বা ‘কৃষ্ণ-ভাবের কল্পিত রূপায়ণই এই কীর্তন পরিবেশনায় পরম লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে।

এই সামগ্রিক আলোচনা থেকে নট সংকীর্তনের তিনটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়- এক. এই কীর্তনে শ্রীগৌরাঙ্গ হচ্ছে রাধা-কৃষ্ণের এক ও অভিন্ন আত্মারূপে যুগ্মাবতার। দুই. পূর্বরঙ্গের গৌরচন্দ্রিকায় রাগালাপে মূর্তি স্থাপনের প্রক্রিয়াটি প্রতীকী, যা চরিত্রের দেহ রূপ মডেল নির্মাণ করে না। ভাব দ্বারা কৃষ্ণের কল্পিত ভাব-দেহকে মূর্ত করে তোলে। তিন. পূর্বরঙ্গ, আখ্যান-অন্ত পর্ব এবং পরিবেশিত আখ্যানের নির্ধারিত অংশের যেখানে শাস্ত্রীয় নর্তনের প্রয়োগ রয়েছে, তা কেবলই পুং-বাদক এবং করতাল-বাদক কর্তৃক পরিবেশিত হয়। বিপরীতক্রমে, আখ্যানের গীতাভিনয়ে গায়েন ও সহ-গায়েনের শরীরাঙ্গে প্রযুক্ত নৃত্য কেবলই দেহের ছন্দময় চলন বা ভাব দেহের দোলা মাত্র। আর এভাবেই এক পৌরাণিক আদর্শ এবং অভেদতত্ত্বের উদ্দীপনায় কীর্তনীয়াগণ পরম আস্থা এবং সত্যমূলক বিশ্বাসে ভক্তে হৃদমাঝারে প্রতিষ্ঠিত করেন আরেক অপরূ দেহ- অভেদ রাধা-কৃষ্ণের ভাব-দেহ।


Saidur Rahman Lipon

লেখক পরিচিতি

সাইদুর রহমান লিপন
লেখক ও গবেষক


গ্রন্থপঞ্জি

  • Ahmed, Syed. Jamil (2000). Acinpakhi Infinity: Indigenous Theatre of Bangladesh. Dhaka: UPL
  • Paniker, K. Ayyappa (2003) Indian Narratology. New Delhi: Indira Gandhi National Center for the Arts
  • Vatsyayan, Kapila (1976). Traditions of Indian Folk Dance. Delhi: Clarion Books
  • Vatsyayan, Kapila (1983). The Square and the Circle of the Indian Arts. New Delhi: Roli Books International.
  • মুখোপাধ্যায়, হরেকৃষ্ণ. (১৯৯০). বাঙ্গালার কীর্তন ও কীর্তনীয়া কলিকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষদ
  • আহমদ, আফসার. (২০১১). চাঁদ নয়, রাধা নেমে এসেছিল মহারাস-পূর্ণিমার আসরে, শুভাশিস সিনহা (সম্পাদিত), মণিপুরী থিয়েটারর পত্রিকা, রাসলীলা বিষয়ক সংখ্যা. কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার: মণিপুরী থিয়েটার
  • বাৎসায়ন, কপিলা (১৯৯৫). ভারতের-নাট্য ঐতিহ্য ইন্ডিয়া: ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট
  • চলিহা, দেবযানী. (২০০৯). মণিপুরী নৃত্যের দুটি ধারা. ওহ ম. মজিদ (সম্পাদিত), আদিবাসী সংস্কৃতি. ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স
  • দর্শনা ঝাভেরী, কলাবতী দেবী (১৯৯৩). শাস্ত্রীয় মণিপুরী নর্তনালয়, কলকাতা: মণিপুরী নর্তনালয়
  • দীন, সেলিম. আল. (১৯৯৮). বাঙলা নাট্যকোষ, ঢাকা: তরফদার প্রকাশনী
  • ধীরেন, থ (২০০৮), বাংলাদেশের মণিপুরী জাতি, সিলেট: মণিপুরী এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন
  • মুখোপাধ্যায়, হরেকৃষ্ণ. (১৯৯০). বাঙ্গালার কীর্তন ও কীর্তনীয়া, কলিকাতা: পশ্চিবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ
  • রূপগোস্বামী, শ্রী. (১৩৪১ বঙ্গাব্দ). উজ্জ্বলনীলমণি (সম্পাদিত, চতুর্থ সংস্করণ). মুর্শিদাবাদ: শ্রী ব্রজনাথমিশ্রেণাস্য
  • সিংহ, বিধান. (২০১৫, জুলাই ১২). রাসনৃত্য. (স. র. লিপন, সাক্ষাৎকার) কমলগঞ্জ
  • সিংহ, রাসধারী. গোপীমোহন (২০১৫, জুলাই ১০) রাসনৃত্য (স. র. লিপন, সাক্ষাৎকার) কমলগঞ্জ
  • হালদার, গোপাল. (১৯৭৪). বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা, ঢাকা: মুক্তধারা
  • দাস, সুইটি. (২০১৫, জানুয়ারী ৬) রাসনৃত্য. (স. র. লিপন, সাক্ষাকৎকার). সাধনা, বনানী, ঢাকা
  • ভট্টাচার্য্য, প্রদ্যোৎ. (২০১২). ভারতীয় দর্শনের রূপরেখা, ঢাকা: রোদেলা
  • রায়, নীহাররঞ্জন. ( ১৩৫৬). বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদিপর্ব, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং

More Publications