ভূতের আস্তানা: লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের অতৃপ্ত আত্মারা (পর্ব: দুই)

ছবি: উইকিপিডিয়া 

লন্ডনের সৌন্দর্য, বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাবসহ হাজারো জটিল এবং নান্দনিক বিষয় নিয়ে কয়েক হাজার পাতার বই লেখা যাবে। তবে লন্ডনের সব জৌলুশময় স্থাপনা আর ঐতিহ্যের মধ্যে আমার কাছে এক মহাবিস্ময়ের নাম লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড রেললাইন; যা টিউব নামেও পরিচিত। ১৮৬৩ সালে যাত্রা শুরু হয় লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের। মাটির প্রায় ৫৮ মিটার অর্থাৎ ১৯০ ফুট নিচে প্রায় ১২ ফুট টানেল তৈরি করে সেই টানেলে সেন্ট্রাল লন্ডনের গভীর পাতালে চলছে দ্রুতগামী সেন্ট্রাল লাইন। ভাবা যায়? সেই সঙ্গে মাটির গভীরে রয়েছে আরও ১১টা রেললাইন এবং ২৭০টি স্টেশন।

দেড় শ বছরের পুরোনো এই আন্ডারগ্রাউন্ডের যেমন রয়েছে বিস্ময়কর ঐতিহ্য, তেমনি আছে দাস প্রথার কালো ছায়া। কারণ, তৎকালীন সময়ে প্রযুক্তির এত উত্তরণ ছিল না, তাই আফ্রিকান ক্রীতদাসদের ব্যবহার করা হতো পাতালরেলের পরিখা খননে। ইতিহাসবিদদের ভাষায়, লন্ডন পাতালরেল তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ দাসদের অস্থি, মজ্জা, রক্ত আর জীবনের দামে।

সেন্ট পল’স। ছবি: জি আর সোহেল
সেন্ট পল’স। ছবি: জি আর সোহেল

এর পাশাপাশি, লন্ডনের ২০০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে আরও একটি বিষয় জড়িত, তা হলো ভূত বা প্রেতের ইতিহাস। কথায় আছে, যে শহরের বয়স যত বেশি, সেই শহরের ভূতেদের শানশওকত ও জৌলুশ ততটাই আকর্ষণীয়। সংগত কারণে শুধু লন্ডন নয়, ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে ভূতের চিহ্নিত আস্তানা রয়েছে; যা হন্টেড বা ভুতুড়ে জায়গা হিসেবে ন্যাশনাল ট্রাস্টে রেজিস্টার্ড। এই ভুতুড়ে জায়গার তালিকায় আছে হাজার বছরের পুরোনো ক্যাসল, গির্জা, কবরস্থান এবং মাটির গভীরে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের স্টেশনের নাম। ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্বে থাকল কভেন্ট গার্ডেনের কথা।

লিস্টার স্কয়ার, যাকে বলে একেবারে হার্ট অব দ্য সিটি—শহরের প্রাণকেন্দ্র। অ্যাপোলো থিয়েটার, অ্যাডলফি থিয়েটার, লাইসিয়াম, ম্যাটিলডা, লাউঞ্জ, পিকচার হাউস, কার্জন, লন্ডন কলোসিয়াম, সারি সারি থিয়েটার কোম্পানি, বিশ্বের নামীদামি নাইট ক্লাব, বার, পান্থশালা। এ যেন ষড়রিপুকে উদযাপন করার হাজার বছরের পুরোনো স্বর্গরাজ্য।

এর ঠিক পরের স্টেশনের নাম কভেন্ট গার্ডেন। হেঁটে গেলে বড়জোর চার মিনিট। সেন্ট্রাল লন্ডনের এই পাতাল রেলস্টেশনটি তৈরি হয় ১৯ শতকের শুরুতে। কভেন্ট গার্ডেনের আজকের জমজমাট অবস্থা শুরুতে মোটেও ছিল না। অনেকটাই নিস্তব্ধ এবং নিঃসঙ্গ স্টেশন হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে একটি বিশেষ কারণে সেই সময় স্টেশনটি পরিচিত হয়ে ওঠে। আর সেই বিশেষ কারণটি হলো, স্টেশনে অথবা প্ল্যাটফর্মে ব্রিটিশ অভিনেতা টেরিসের অশরীরী আত্মার চলাচল।

সেন্ট্রাল লন্ডনের কভেন্ট গার্ডেনের বাসিন্দা উইলিয়াম টেরিস ছিলেন একজন জনপ্রিয় ইংলিশ অভিনেতা। ১৮৭১ সালে তাঁর অভিনীত ‘রবিনহুড’ এবং ‘রেবেকা’ ফিল্ম দুটি তাঁকে দিয়েছিল আকাশছোঁয়া খ্যাতি। ১৮৮০ সালে শেকসপিয়ারের নাটকে অভিনয় করার জন্য টেরিস যুক্ত হন দুনিয়ামাতানো থিয়েটার কোম্পানি লাইসিয়াম থিয়েটারের হেনরি আরভিংয়ে। ১৮৮০ সালের শেষের দিকে ‘মেলোড্রামা’ শীর্ষক একটি প্রযোজনার জন্য তিনি যুক্ত হন আরও একটি দুনিয়াখ্যাত থিয়েটার কোম্পানি অ্যাডলফি থিয়েটারে। অ্যাডলফিতে যুক্ত হওয়াই যেন কাল হলো জন-আদৃত এই অভিনেতার জীবনে।

অকাল প্রয়াত অভিনেতা উইলিয়াম টেরিসছবি: উইকিপিডিয়া
অকাল প্রয়াত অভিনেতা উইলিয়াম টেরিসছবি: উইকিপিডিয়া

মাত্র ৪৯ বছর বয়সে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই ব্রিটিশ অভিনেতা ১৮৯৭ সালে অ্যাডলফি থিয়েটারের সহ-অভিনেতা রিচার্ড পিয়ার্সের হাতে খুন হন নির্মমভাবে। খুন হয়ে যাওয়ার পর কভেন্ট গার্ডেনের গর্ব টেরিসের অতৃপ্ত অশরীরী আত্মাকে দেখা যেতে লাগল ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায়। প্রথমে টেরিসের অভিনয়ের জায়গা অ্যাডলফি থিয়েটার এবং লাইসিয়াম থিয়েটারের আশপাশে দেখা গেলেও ১৯০৬ সালে কভেন্ট গার্ডেন পাতাল রেলস্টেশন উদ্বোধনের পর থেকে টেরিসের অশরীরী আত্মা স্থায়ীভাবে আস্তানা গাড়ে পাতালরেলের গভীরতম রেললাইন এবং প্ল্যাটফর্মে।

কভেন্ট গার্ডেন স্টেশন টেরিসের মনে ধরে; কারণ তাঁর মৃত্যুর আগে ঠিক যে জায়গায় স্টেশনটা হয়েছে, সেখানে একটা বেকারি ছিল এবং সেই বেকারিতে তিনি ছিলেন বেশ নিয়মিত খদ্দের। যাঁরা লন্ডনে এসেছেন বা থাকেন, তাঁদের জন্য কভেন্ট গার্ডেন একটি অতিপরিচিত স্টেশন; কারণ এর পাশেই বিখ্যাত লিস্টার স্কয়ার, হলবোর্ন ও পিকাডেলি সার্কাস। যেখানে সপ্তাহান্তের পার্টিতে চিয়ার্স শব্দে কাচের গ্লাসের ঠোকাঠুকিতে চলে মোহ আর মাৎসর্যের অবাধ আস্ফালন।

লন্ডনের প্রায় সব পাতাল রেলস্টেশনই গভীর রাতে খানিকটা ভুতুড়ে মনে হয়। চারপাশ বদ্ধ থাকার কারণে একা হাঁটলে নিজের পায়ের আওয়াজ অথবা অন্য কারও চলে যাওয়ার শব্দের প্রতিধ্বনি নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে।

তেমনি এক রাতে শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পর পাতালরেল ইঞ্জিনিয়াররা রুটিন চেকাপ শুরু করেছেন। হঠাৎ করেই একটা ছায়া নজরে এল। ছায়ার পরনে ফরমাল প্রম ড্রেস এবং টাক্সিডো হ্যাট। সেই সঙ্গে জুতার খটাখট খটাখট খটাখট আওয়াজ। সেই রাতে ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করলেন ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে থেকে গেল সেই প্রম ড্রেস, টাক্সিডো হ্যাট এবং জুতার খটাখট আওয়াজ।

কভেন্ট গার্ডেনের এক সাবেক টিকিট কালেক্টরের বয়ানে উঠে এসেছিল সেই একই গল্প। এক রাতে ধু ধু প্ল্যাটফর্মে ফাইনাল সিকিউরিটি চেক করছিলেন, হঠাৎ করেই আচমকা এক উঁচু লম্বা লোক, দেখতে ঠিক একই যেমনটা ইঞ্জিনিয়াররা দেখেছিলেন। একই প্রম ড্রেস, টাক্সিডো হ্যাট আর খটাখট জুতার আওয়াজ। সেই লোক ধুম করেই ইমার্জেন্সি স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে ওঠা শুরু করল।

কভেন্ট গার্ডেন স্টেশনের প্রবেশমুখছবি: লেখক
কভেন্ট গার্ডেন স্টেশনের প্রবেশমুখছবি: লেখক

টিকিট কালেক্টর তখন তাড়াতাড়ি ওপরে স্টেশনের ক্লার্ককে ফোন করে জানালেন, একজন লোক ইমার্জেন্সি সিঁড়ি বেয়ে অস্বাভাবিক ভাবে ওপরে উঠছে। যেহেতু প্ল্যাটফর্ম প্রায় ২০০ ফুট মাটির গভীরে, তাই সিঁড়ি ভেঙে উঠেতে প্রচুর সময় লাগবে। অস্বাভাবিক লোকটাকে হাতেনাতে ধরতে টিকিট কালেক্টর নিজেও লিফট ধরে ওপরে চলে এলেন। কিন্তু কাউকে আর পাওয়া গেল না।

এইভাবে নানা সময়ে উইলিয়াম টেরিসের অশরীরী আত্মার অভিন্ন অবয়ব দেখা যেতে লাগল স্টেশনের আনাচকানাচে। কখনো স্টাফরুমে খাবার খেতে, আবার কখনো পাতালরেলের সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে। সেই থেকে কভেন্ট গার্ডেন স্টেশন ন্যাশনাল ট্রাস্টে রেজিস্টার্ড হয় হন্টেড স্টেশন হিসেবে।

ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডনের তথ্যমতে, সর্বশেষ উইলিয়াম টেরিসের অশরীরী আত্মাকে দেখা গেছে ১৯৭২ সালে।

লেখক: পিএইচডি গবেষক ও প্রভাষক, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, এংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ

Logo of prothomalo

Others Writeup of Ashim Chakraborty