
লন্ডনের সৌন্দর্য, বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাবসহ হাজারো জটিল এবং নান্দনিক বিষয় নিয়ে কয়েক হাজার পাতার বই লেখা যাবে। তবে লন্ডনের সব জৌলুশময় স্থাপনা আর ঐতিহ্যের মধ্যে আমার কাছে এক মহাবিস্ময়ের নাম লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড রেললাইন, যা টিউব নামেও পরিচিত। ১৮৬৩ সালে যাত্রা শুরু হয় লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের। মাটির প্রায় ৫৮ মিটার, অর্থাৎ ১৯০ ফুট নিচে প্রায় ১২ ফুট টানেল তৈরি করে সেই টানেলে সেন্ট্রাল লন্ডনের গভীর পাতালে চলছে দ্রুতগামী সেন্ট্রাল লাইন। ভাবা যায়? সেই সঙ্গে মাটির গভীরে রয়েছে আরও ১১টা রেললাইন এবং ২৭০টি স্টেশন।
দেড় শ বছরের পুরোনো এই আন্ডারগ্রাউন্ডের যেমন রয়েছে বিস্ময়কর ঐতিহ্য, তেমনি আছে দাসপ্রথার কালো ছায়া। কারণ, তৎকালীন সময়ে প্রযুক্তির এত উত্তরণ ছিল না, তাই আফ্রিকান ক্রীতদাসদের ব্যবহার করা হতো পাতালরেলের পরিখা খননে। ইতিহাসবিদদের ভাষায়, লন্ডন পাতালরেল তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ দাসদের অস্থি, মজ্জা, রক্ত আর জীবনের দামে।
এর পাশাপাশি লন্ডনের দুই হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে আরও একটি বিষয় জড়িত, তা হলো ভূত বা প্রেতের ইতিহাস। কথায় আছে, যে শহরের বয়স যত বেশি, সেই শহরের ভূতদের শানশওকত ও জৌলুশ ততটাই আকর্ষণীয়।

সংগত কারণে শুধু লন্ডন নয়, ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে ভূতের চিহ্নিত আস্তানা রয়েছে, যা হন্টেড বা ভুতুড়ে জায়গা হিসেবে ন্যাশনাল ট্রাস্টে রেজিস্টার্ড। এই ভুতুড়ে জায়গার তালিকায় আছে হাজার বছরের পুরোনো ক্যাসল, গির্জা, কবরস্থান এবং মাটির গভীরে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের স্টেশনের নাম। ধারাবাহিকের শেষ পর্বে থাকল আরো কয়েকটি স্টেশন ও স্থাপনার কথা।

আরও যত ভূতের আস্তানা
এই হন্টেড স্টেশনের তালিকায় আরও স্থান করে নিয়েছে লন্ডনের এলিফ্যান্ট অ্যান্ড ক্যাসল স্টেশন, ফ্যারিংডন স্টেশন, ওল্ডগেট, হাইগেট এবং কিংসক্রস স্টেশন। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন ছাড়াও গ্রেট ব্রিটেনের প্রচুর পুরোনো ক্যাসল, গির্জা, মিউজিয়াম এবং কটেজও হন্টেড স্থাপনা হিসেবে ব্রিটিশ হেরিটেজ বিভাগের ওয়েবসাইটে তালিকাভুক্ত আছে।
সরকারের অধিদপ্তর সেই স্থাপনার গল্প আর ভূতদেরও সংরক্ষণ করে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে, অথচ আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো। আমরা ধ্বংসে বিশ্বাসী। সেই ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পায় না ঐতিহাসিক ভবন, লোকজ কৃষ্টি, সংস্কৃতি কিছুই।

অথচ একটি জাতির নিজস্ব পরিচয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য বহন করে এসব প্রাগৈতিহাসিক স্থাপনা, সেসব ঘিরে হাজারো গল্প ও মিথ। ব্যক্তিগতভাবে আমি শৈশব ও কৈশোরে ভূতের গল্প শুনেছি আশপাশের বয়স্ক মানুষের মুখে, তবে তেনাদের দর্শন লাভ করিনি কখনো।
সরকারের অধিদপ্তর সেই স্থাপনার গল্প আর ভূতদেরও সংরক্ষণ করে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে, অথচ আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো। আমরা ধ্বংসে বিশ্বাসী। সেই ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পায় না ঐতিহাসিক ভবন, লোকজ কৃষ্টি, সংস্কৃতি কিছুই।
অথচ একটি জাতির নিজস্ব পরিচয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য বহন করে এসব প্রাগৈতিহাসিক স্থাপনা, সেসব ঘিরে হাজারো গল্প ও মিথ। ব্যক্তিগতভাবে আমি শৈশব ও কৈশোরে ভূতের গল্প শুনেছি আশপাশের বয়স্ক মানুষের মুখে, তবে তেনাদের দর্শন লাভ করিনি কখনো।

অবশ্য নভেম্বরের এক পাতাঝরা রাতে কেমব্রিজে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কসলেট বিল্ডিংয়ের নিচতলার ক্যাফেতে বসে নির্জনে কাজ করছিলাম। সেই রাতে একটা ঘটনা ঘটে। সবাই চলে গেছে তখন। সুনসান চারপাশ। হঠাৎ দেখি চোখের সামনে নিজে নিজেই খুলে যাচ্ছিল চেয়ার দিয়ে শক্ত করে চাপা দেওয়া দরজা। কেন জানি তাৎক্ষণিক ভয় পাইনি বটে, তবে এর কোনো ব্যাখ্যাও পাইনি। পরে শুনেছিলাম ওই ভবনটা নাকি হন্টেড ভবন হিসেবে চিহ্নিত। সেই গল্প না হয় তোলা থাক। বলব অন্য কোনো একদিন। (শেষ)
লেখক: পিএইচডি গবেষক ও প্রভাষক, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, এংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ
