নাচে ভক্তি নাচেই মুক্তি: পদ্মপুরাণে ছুকরি নৃত্য এবং একটি পর্যালোচনা

আলোচ্য প্রবন্ধে বাংলা অঞ্চলের অনার্য ধর্ম সম্ভূত সর্পদেবী মনসা বিষয়ক আখ্যান পদ্মপুরাণের দুটি জনপ্রিয় পরিবেশনা- কুষ্টিয়ার ‘পদ্মার নাচন’ এবং টাঙ্গাইলের ‘বেহুলার নাচারীর অন্তর্গত ছুকরি নৃত্যে কুশীলবের ভাব ও ভক্তির প্রদর্শন প্রক্রিয়া এবং প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শন পদ্ধতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। বক্ষমাণ রচনায় পরিবেশনা দুটির প্রদর্শন-পর্যবেক্ষণ এবং ধারণকৃত সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণের মাধ্যমে পুরুষ কুশীলবের ছুকরি বা নারী হওয়ার প্রথা ও পুরাণগত পরিবেশনা-জ্ঞান অনুসন্ধানের প্রয়াস রয়েছে। অতঃপর, প্রবংশজাত এই জ্ঞান পুরুষ কুশীলবের ‘মনোদৈহিক’ ও ‘সামাজিক’ শরীরে প্রযুক্ত হয়ে কিভাবে ছুকরির রূপান্তর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

Nache vokti nache mukti

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের কৃষি ও কৃত্য নির্ভর জীবনাচারে বিকশিত বেশকিছু লোকনাট্যের অভিনয় প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে ছুকরির নাচ বা ‘ছুকরি নৃত্য’। ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ভিত্তিক এই সকল নাট্যে রয়েছে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ কুশীলবের রূপান্তরিত নারী’ বা ‘ছুকরির বহুমাত্রিক উপস্থিতি। সাধারণত লৌকিক পর্যায়ে সামাজিক বয়ানে কিশোরী/তরুণীদেরকে ‘ছুকরি’ বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে ‘যৌনপল্লীতে বেড়ে ওঠা দশ থেকে সতের বছর বয়সী যে সকল কিশোরী চোখে-মুখে রঙ মেখে খদ্দের আকৃষ্ট করে তাদেরকে ‘ছুকরি’ বলা হয়’ (মাসুদুজ্জামান ২০০৬)। তবে কৃষিভিত্তিক পরিবেশনা শিল্পকলার বয়ানে যে সকল পুরুষ কুশীলব নারী’ সাজে নৃত্যে বা চরিত্রাভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন, মূলত তাদেরকেই ছুকরি’ নামে ডাকা হয়। এই কুশীলবগণ নিপুণ দক্ষতার সাথে সাজ-পোশাকে, ভাব-বিশ্বাসে, আচার-ব্যবহারে নিজেদেরকে রূপান্তরিত লিঙ্গে উপস্থাপন করেন। হাজির হন ভাবোদ্দীপক কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নারী-চরিত্রে। নৃত্য ও চরিত্রাভিনয়ে ছুকরিদের উপস্থিতি সাধারণ দর্শক মনে যে কেবলই কৌতুকপূর্ণ ভাব ও বিনোদনের খোরাক মেটায়, বিষয়টি মোটেই সে রকম নয়। বরং কুষ্টিয়া ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে পদ্মপুরাণের ছুকরি নৃত্য ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে ‘উপকারের নাচ হিসেবে (ছুকরি হামেদ আলী ২০১৭), সামাজিক জীবনে প্রয়োজনের অনুষঙ্গ হিসেবে (ছুকরি বারেক আলী ২০১৭), আবার ধর্মীয় জীবনে ভক্তি ও বিশ্বাসের অবলম্বন হিসেবে (শলোক ২০১৭) পরিবেশিত হয়ে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে।

কুষ্টিয়া অঞ্চলেরর ছুকরি নৃত্য পরিবেশনা।

পদ্মার নাচন ও বেহুলার নাচাড়ি

বাংলা ভূখণ্ডের প্রায় সকল অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে লৌকিক আখ্যান পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল’-এর দেবী মনসার অগণিত বিশ্বাসী ও ভক্ত। এই ভক্ত-বিশ্বাসীদের মধ্যে রয়েছে বহু সংগঠন, যারা নিয়মিতভাবে পদ্মপুরাণ পরিবেশন করে থাকে। দলগুলোর গঠন, পরিচালন ও পরিবেশন প্রক্রিয়ায় কোথাও রয়েছে শুধু নারী কুশীলব, কোথাও আবার বিধবা, কোথাও আছে ‘গুরমি’ (তৃতীয় লিঙ্গ) শুধু, কোথাও কেবল হিন্দু, আবার কোথাও রয়েছে মুসলমান ।। কুষ্টিয়ার পদ্মার নাচন এবং টাঙ্গাইলের বেহুলার নাচারী দলের ছুকরি, ওঁঝা/ঠাকুরসহ সকল কুশীলবই জন্মসূত্রে মুসলমান। এই দুটি দল পরিচালিত হয় বায়নাসূত্রে পেশাদারিত্বের সাথে। সংশ্লিষ্ট দলের কুশীলবদের বিশ্বাস এমন যে, এই অঞ্চলগুলোতে সাপের প্রাদুর্ভাব ও সর্পদংশনের ঘটনা বেশি। তাছাড়া এলাকার মানুষের মাঝে প্রচলিত রয়েছে সর্প বিষয়ে বহু গল্প-গাঁথা। ফলে এই অঞ্চলগুলোর হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে ‘মানত’ পূরণ, কৃত্য’ পালন ‘উপকার সাধন বা। ‘প্রয়োজনের নিমিত্তে মনসা বিষয়ক পরিবেশনা পদ্মার নাচন ও বেহুলার নাচারী বায়না করে থাকে। যেমন- তান্ত্রিক ওঁঝা/ঠাকুরের চিকিৎসায় সাপেকাটা রোগী ভাল করতে, শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে, বাচ্চা না হওয়ায়, বিশেষ রোগ-বালাই- ‘বাতাস লাগা’ শক্তিহীন নিস্তেজ হওয়া) থেকে ভাল হতে অথবা সর্পদংশনের দুঃস্বপ্ন থেকে সৃষ্ট অস্থির-অসুস্থতা থেকে মুক্তি লাভের উপলক্ষ্যে ; সামাজিক প্রয়োজনে- যেমন, গ্রামে নতুন বাজার নির্মাণ এবং বাজার জমাতে’; ‘হাউসের গান’ (বিনোদনের) হিসেবে বিয়ে, আকিকা, খৎনা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ; ধর্মীয় অনুষ্ঠান- যেমন, দুর্গাপূজা, মনসাপূজা প্রভৃতি উপলক্ষ্যে পরিবেশিত হয় পদ্মার নাচন ও বেহুলার নাচাড়ি। ফলে নিশ্চিতভাবেই পদ্মার নাচন ও বেহুলার নাচাড়ি’ পরিবেশনা দুটি স্থানীয় লৌকিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় লক্ষণীয় সামাজিক গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। তাই এই অঞ্চলগুলোতে ‘ছুকরি’রা শুধুই সাজ-পোশাকে রূপান্তরিত লিঙ্গের ধারণায় ‘বিনোদনের নারী কুশীলব নয়। এঁরা হলেন প্রয়োজনের নিমিত্তে হয়ে ওঠা ‘ছুকরি সহজেই ধর্ম-সহিষ্ণু সাধারণের মাঝে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হন। টাঙ্গাইলের ছুকরি হামেদ আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, এই নাচ খালি রঙের নাচ না। এইডা একটা পেশা। রোজার (ওঁঝা) বিষ ঝাড়া, সাথে নাচ-গান- দুয়ে মিলে সাপেকাটা রোগী, শরীরের বিষ ব্যথা, নানান বিপদ আপদ থেকে মানুষের উপকার করার জন্য এই গান। নাচ-গান করলে বিষটা নামে, তাই এই গান করি, তাই সবাই আমাগোরে ডাকে’ (ছুকরি হামেদ আলী ২০১৭)।

কিন্তু পেশা ও মানতের গান হলেও ধর্ম ও সমাজে এর যুক্তি কি? এমন প্রশ্নের জবাবে পদ্মার নাচনের ওস্তাদ মোঃ. রেজাউল হক সলোক’এর যুক্তি হচ্ছে-

আল্লাপাক যখন সবাইকে সৃষ্টি করেছেন তখন তিনিই একেক জনকে এক একরূপে পাঠিয়েছেন। হয়তো তিনিই দেবীকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহতালা নিজেই বলেছেন উছিলার মাধ্যমে তালাশ কর। এখানে উছিলা কোনো দেবী হতে পারে, আবার কোনো পীর, দরবেশ আউলিয়াও হতে পারে। এই রকম মনসার উছিলায় বা কল্যাণে যদি আমার পাপটা দূর হয়, বালা-মুসিবত দূর হয় তবে এই কার্য করতে দোষ কোথায়? হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে নয়, কেবল মনসার একজন ভক্ত হিসেবে এই কাজ করতে হয় (শলোক ২০১৭)।


অপরদিকে টাঙ্গাইল অঞ্চলে বেহুলার নাচাড়ির ওস্তাদ নাজিম উদ্দিনের ভাষ্য হচ্ছে-

আমাদের গ্রামের হাজী, গাজী, মুন্সি, মৌলানা, মেম্বার মাতব্বর এমন কোনো মানুষ নাই যারা আমাদের সাথে যুক্ত নাই। আমিতো মুসলমান, আমি রোজা রাখি, নামাজ পড়ি, তারপরও আমি এইডা পালন করি। এইডা পালন করার একটাই কারণ, এইডা মানুষের উপকারে আসে। এই শাস্ত্রডা এই অঞ্চলে হিন্দুরা গায় না, হিন্দুগো শাস্ত্রডাই মুসলমানে গায়। এই এলাকার কোনো হিন্দুই এই বেহুলার লাচারি করে না। এই অঞ্চলে পদ্মাকে শাস্ত্রের দেবী নয়, উপকারের দেবী হিসেবে মানা হয় (নাজিমুদ্দিন ২০১৭)।


এই প্রসঙ্গে ছুকরি শেরেবুল ইসলামে স্পষ্ট মন্তব্য-

হ্যাঁ, আল্লা আমাকে পুরুষ করেই পাঠিয়েছে। কিন্তু আমিতো মেয়ে সেজেই ‘অলস্ট্যান্ড’ (সর্বক্ষণ) থাকছি না। আমি কার্যক্ষেত্রে রূপ পরিবর্তন করছি মাত্র। আমার দ্বারা মেয়ে সেজেই হোক, যদি মানুষের কিঞ্চিত পরিমাণ উপকার হয়, ওতেই আমি ধন্য (ছুকরি শেরেবুল ইসলাম ২০১৭)।


তাই দুটি দলের কারো কাছেই মনসা দেবী নন। তাঁরা ভক্তি’ করেন মনসাকে, আস্থা রাখেন- মনসার শক্তি’তে। বস্তুত সহজ ‘বিশ্বাস’ ও ‘ভক্তি ভাবে মেনে নেওয়া মনসার আখ্যান এ অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান সাধারণের মাঝে শক্তি’ সাধনার এক অনন্য সামাজিক কৃত্যানুষঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ফলে পদ্মপুরাণ অভিনয় প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছুকরিরাও পেয়ে যায় সাধারণ গৃহস্থের অবাধ স্বীকৃতি। এমনও বলা হয় যে, ছুকরিদের নাচ ও গানের উপরেই বহু গ্রামে, বহু পুরুষ ও নারীর সাথে আত্মীয়তা, মায়া, মহব্বত আর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আবার ভাল নাচে বলে অন্য এলাকা থেকে এসে ছুকরিদের তুলে নিয়ে যায়, এমন ঘটনাও ঘটে থাকে’(ছুকরি শেরেবুল ইসলাম ২০১৭)। সামাজিকীকরণের এই অনন্য উর্বর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাই ছুকরি হওয়ার বিষয়টি নেহাতই ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বিষয় হয়ে থাকে না বরং তা এই অঞ্চলগুলোর গণ-মনে সৃষ্ট চাহিদারও বিষয় হয়ে ওঠে। ভাব শক্তির অদ্বৈত রূপ ও রূপান্তরের ধারণা নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক কিছু পরিবেশনা ব্যতীত বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকনাট্যের কুশীলব লিঙ্গ পরিচয়ে হয় পুরুষ’। এই পুরুষ কুশীলবদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা নিপুণ দক্ষতার সাথে লিঙ্গ থেকে লিঙ্গে ভ্রমণ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় নারী চরিত্রে বা নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। সাধারণত তিনটি প্রক্রিয়ায় এটি সম্পাদিত হয়ে থাকে-

ক. বর্ণাত্মক অভিনয় প্রক্রিয়ায় তৃতীয় পুরুষে ‘নারী চরিত্রের প্রদর্শন ।
খ. দেহের ছন্দে, শৌর্যে এবং পোশাকের বহুমাত্রিক সমন্বয়সূত্রে উত্তম পুরুষে নারী-চরিত্রের প্রদর্শন।
গ. সাজ-পোশাকে, ভাব-ভঙ্গিমায়, দেহ-শৌর্যে লিঙ্গ রূপান্তরের মাধ্যমে পরিপূর্ণ নারীর অবয়বে ‘ছুকরির মনো-দৈহিক উপস্থাপন।

পদ্মার নাচন ও বেহুলার নাচাড়ি পালায় ছুকরি নৃত্য পরিবেশনা।


বাংলার হাজার বছরের নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতিতে লিঙ্গ থেকে লিঙ্গে ভ্রমণ বা রূপান্তরের এই পরিবেশন-প্রক্রিয়ার মূলে রয়েছে প্রথা ও পরম্পরাগত পরিবেশনা-জ্ঞান। কারো মতে দেশজ নাট্যকলায় লিঙ্গ থেকে লিঙ্গে ভ্রমণে এ হচ্ছে এক ‘দ্বিদেহী’ নাট্যতত্ত্ব। লিঙ্গ থেকে লিঙ্গে ভ্রমণের এই রসায়ন বুঝতে হলে বাংলা অঞ্চলের সহজ ভাব ও ধর্ম-দর্শনের দৃষ্টিতে ‘দেহ’ শব্দটির গূঢ় অর্থ-ব্যঞ্জনা এবং দেহ-অন্তঃপুরে প্রবহমান। শৌর্যের অদ্বৈত রূপ-রহস্যের সাথে ‘ভাবের যে সম্পর্ক তা অনুধাবন করা প্রয়োজন। বলা হয়ে থাকে যে, বাংলায় ‘ দেহ ছাড়া ভাব নেই, এবং ভাব ছাড়া দেহ নাই’ (মজহার ২০০৯)। বাংলায় এক ‘ দেহ’ তেই খুঁজে নিয়েছে কৈলাস, হিমালয়, মক্কা, মদিনা আর কাশী-বৃন্দাবন আবার এই দেহ-অন্তঃপুরেই বাস করেছে আল্লারাসুল, হর-গৌরী, কৃষ্ণ-রাধিকা আরও কত লীলা-নাট্য গীতি-পাঁচালী (শরীফ ২০০৯)। এই আধ্যাত্মবাদে ভাব’ ও ‘দেহ’ একই সাথে সমার্থক এবং অভেদাত্মক। ফলে বাংলা অঞ্চলে হাজার বছরের নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতির শিকড়ে প্রথিত ‘ভাব’, ‘দেহ এবং দেহ-অন্তঃপুরে ক্রিয়াশীল শৌর্যের অদ্বৈতরূপ কখনো পুরুষ-নারী, পুরুষ- প্রকৃতি, শিব-শক্তি, চন্দ্র-সূর্য, জীবাত্মা-পরমাত্মা, প্রভৃতি নামে পরিপুষ্ট হয়েছে। পৌরাণিক, লৌকিক, সহজ ভাব, ধর্ম ও দর্শনের বিচিত্র শাখা-প্রশাখায়। ফলে নৃত্য ও নাট্য-নৃতত্ত্বের ধারনায় এই অঞ্চলে তাণ্ডব ও লাস্য নামে শক্তির যে দুটি রূপ পাওয়া যায়, সে তো পৌরাণিক নটরাজ শিব নিজেরই ‘এক দেহের ‘দুই বিপরীত শক্তিরূপ- শিব ও পার্বতী। যিনি নিজ দেহের অর্ধেক পুরুষ’ রূপ আর অর্ধেক তাঁরই স্ত্রী পার্বতীর যুগলরূপ অর্থাৎ অর্ধেক নারী, অর্ধেক পুরুষরূপে হয়েছেন অর্ধনারীশ্বর। তন্ত্র ধর্মের শিব ও শক্তি সে তো ভারতের ‘অনার্য পুরুষ-প্রকৃতি চিন্তাধারার ক্রমবিকাশে শিব-শক্তি, বিষ্ণু-লক্ষ্মী’ প্রভৃতি তত্ত্বে হয়েছে রূপান্তরিত (শরীফ ২০০৯)। আবার এমনও বলা হয় যে, পুরুষ-প্রকৃতির ধারণা মূলত প্রাচীন ভারতীয় উর্বরা বা মাতৃকাতন্ত্রেরই রূপান্তরিত শক্তি, যা ক্রমান্বয়ে ‘শিবের মতো কৃষ্ণ বা বিষ্ণুই বৈষ্ণব মতে পরম পুরুষ এবং এই পুরুষের প্রকৃতি বা শক্তি হচ্ছে রাধা (রায়হান ২০০৯)। অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি এক্ষেত্রে রাধা ও কৃষ্ণের যুগল রূপ। ভারতীয় যোগ বা কায়া সাধনাতেও দেহভাণ্ডে ‘male energy Ges ‘female energy’ (Angel, Two Energies, One Body – Balance Your Male – Female Sides 2008)- এই দুই বিপরীত কিন্তু অদ্বৈত শক্তিরূপের চর্চা করা হয়েছে। এখানে পুরুষ হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক- সূর্য এবং নারী হচ্ছে এই ব্রহ্মাণ্ডের অর্থাৎ পুরুষের শক্তি- চন্দ্র। এই যোগ সাধনাতে দেহ-অন্তঃপুরে শিব ও শক্তির এক বিরামহীন নৃত্য প্রবাহ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। কেবল সনাতনী বা পৌরাণিক সংস্কৃতিতেই নয়, বাংলার লৌকিক’ ইসলাম, যেখানে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং আর্য, অনাআর্য ও বৈষ্ণব-বিশ্বাস করেছে প্রবেশ’ (Haque 2009), সেই ধর্মও এই ‘ভাব’ এবং শক্তি’ সাধনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেনি। ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব প্রভাবে বাংলায় মুসলিম কবিরা জীবাত্মা-পরমাত্মার রূপক হিসেবে রাধা-কৃষ্ণকে গ্রহণ করেছিলেন, রাধা-কৃষ্ণ কখনো কখনো কায়াসাধক সূফীর বা বাউল রচনায় দেহ ও আত্মার রূপক হিসেবেও ব্যবহৃত’ (শরীফ, চৈতন্য মতবাদ ও ইসলাম ২০০৯)। বুঝতেই হয়। কেননা ভাব’ কখনোই ‘দেহ’কে ছেড়ে অন্য কোথাও অধিষ্ঠান। করেনি। কারণ বাংলা অঞ্চলে শক্তি’ ও ‘ভাব’ সমার্থক। অর্থাৎ ‘পুরুষ ভাব’ এবং ‘নারী ভাব’ও বটে। বাংলার নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতির হাজার বছরের পরিক্রমায় ক্রিয়াশীল ভাব ও শক্তির এই সহজ জ্ঞানই বস্তুত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের দেহরূপ ভাব-চৈতন্যে প্রবহমান। প্রথা ও পরম্পরাসূত্রে প্রাপ্ত এই জ্ঞান সূত্রেই সম্ভবত বাংলার কুশীলবগণ লিঙ্গ থেকে লিঙ্গে ভ্রমণ বা রূপান্তরের শিল্প-প্রক্রিয়াকে সহজাত করে তোলেন। আর এ কারণেই হাজার হাজার বছর ধরে ছোকরারা এদেশে ছুকরি রূপ নেয় সহজেই। কুশীলবের অন্তঃপুরের তাণ্ডব ও লাস্য শক্তির যুগপৎ উপস্থিতির কারণে পুরুষ শিল্পী প্রবংশজাত জ্ঞানের প্রয়োগে নারীভাব প্রকাশ করতে সক্ষম হয়’ (মইশান ২০১৬)।

ছুকরির শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ

ছুকরি-১: দলের সাথে থাইকা, আসরে বসে দেখে দেখেই এই নাচ শিখতে হয়। অনেক সময় পুরানো প্লেয়ার বা বড়রা নাচের ইশারা দেয় যে এইভাবে এইভাবে নাচতে হয়, আমরা সেই ইশারা দেখে দেখে নাচ শিখে নেই (ছুকরি হামেদ আলী ২০১৭)।

ছুকরি-২: আসরে বসে দেখে দেখে ট্রেনিং লিছি। আসরে দেখে মাটিতে ছক এঁকে তা কাগজে তুলে নিয়ে বাড়িতে বসে চর্চা করতাম। আমি নিজেই একা ঘরে মাটিতে ছক এঁকে নিতাম, ডা পা কোথায় যাচ্ছে, বাম পা কোথায় আসছে। এইভাবে আমি নিজের কাছে নিজেই পরিপূর্ণ হয়েছি যে, আমি একা নাচতে পারবো (ছুকরি শেরেবুল ইসলাম ২০১৭)।


ছুকরি নৃত্যের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে ছুকরি এবং ওস্তাদের অভিমত ঠিক এরকম যে, এই নাচ আসরে উপস্থিত থেকে দেখে দেখেই শিখে নিতে হয়। কেউ হাতেকলমে শিখিয়ে দেয় না। যার অর্থ হচ্ছে, আসরে উপস্থিত থেকে অনানুষ্ঠানিক কিন্তু গ্রহণযোগ্য সামাজিক প্রক্রিয়াতেই আগ্রহী কুশীলবগণ শিখে নেয় ছুকরি নৃত্যের প্রাথমিক তথা ব্যবহারিক পাঠ। স্পষ্টতই এই শিক্ষণ প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক বয়ান বা পেডাগোজিক্যাল বিবরণ নির্ভর নয়। সম্পূর্ণটি অনানুষ্ঠানিক ‘Oral method বা traditional method of dance education at wala fales (Sahai 2011), যা অর্জিত হয় প্রচলিত ‘trans-personal experience’ (Schechner 2002) বা ব্যক্তির-অধিক সমষ্টির শিল্প-জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আশ্রয়ে। কেননা, এইরূপ। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় একজন পুরুষ রূপান্তরিত নারীময়’ শরীর, ভাষা ও মনোভঙ্গি প্রদর্শনের যাবতীয় উপাদান সমষ্টির বয়ানে উচ্চারিত ছুকরি’, ‘কিশোরী, ‘সুন্দরী’ তথা নারী’ অথবা লৈঙ্গিক (স্ত্রী) ধারণায় প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় সকল সামাজিক পাঠ ও পঠন থেকেই শিখে নিতে পারে। নারীরূপে নারীময় হয়ে ওঠার বা ছুকরির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় টাঙ্গাইলের কুশীলব জুলহাস মিঞার সামাজিক পাঠটি ছিল ঠিক এরকম-

আসলে তো মহিলাদের কথা ছোট ছোট করে বলা’, মানে পুরুষদের থেকে নিচে। অর্থাৎ আস্তে আস্তে নরম সুরে কথা বলতে হয়, এইভাবেই আমরা নারীর ভাব ধরে থাকি। আর নারীর পোশাক পইরা যখন কোনো পুরুষ চরিত্রের সামনে দাঁড়াই তখন আলগাই ভিতর তন আইসা যায় যে, আমি আসলে প্রকৃত পক্ষে মহিলা। অর্থাৎ যখন আমি নারী চরিত্রে অভিনয় করি তখন আমার ভিতরে, আমার মনডায় একটা ‘দুর্বল’ আইসা যায়। আর। এইগুলা (পোশাক) পড়লে মনের আনন্দেই নারী ভাব আইসা যায় (ছুকরি জুলহাস মিঞা ২০১৭)।


স্পষ্টতই এটি হচ্ছে নারী বিষয়ক একটি সামাজিক বয়ান- অর্থাৎ, ছোট করে কথা বলা, নরম সুরে কথা বলা, পুরুষের সামনে দুর্বল হওয়া প্রভৃতি। এগুলোই জুলহাসের ছুকরি’তে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সামাজিক ‘পাঠ’ বা টেক্সট হিসেবে কার্যকর হয়। Shrinkhla Sahai এর ব্যাখ্যায় এভাবেই একটি নৃত্য- দেহর socio-cultural text-এ পরিণত হয় (Sahai 2011)। যে প্রক্রিয়ায় এই সোস্যাল টেক্সট পুরুষের দেহে, ভাবে ও ভঙ্গিতে উদ্ভাসিত হয়ে ছুকরির রূপান্তর প্রক্রিয়াকে সম্ভব করে, সে প্রসঙ্গে ছুকরি শেরেবুল বলেন-

আমিতো ছেলে, কিন্তু আমি যদি ভাবি আমি ছেলে তবে তো আমি ঐ রূপ ধরতে পারবো না। যখন মেকাপটা করছি, পুরুষতো আর মেকাপ করছে না, চোখে কাজল দিচ্ছি, ভাব পরিবর্তন হচ্ছে, কপালে ভ্র-পেন দিচ্ছি, টিপ। দিচ্ছি, হাতে চুড়ি পরছি, তখনই কিন্তু আমার ভাবমুর্তি মেয়েলি চলে আসছে। গায়ে বেলাউজ পরছি, মেয়েদের যেমন ‘তন’ (স্তন) আছে, তনটাও বানাচ্ছি, শাড়ি পরে এবার কিন্তু অবিকল একটা ফুল’ (পরিপূর্ণ) মেয়ে হয়ে গেলাম। এই ‘ডেসাপ’ই (পোশাক) কিন্তু আমাকে বলে দিচ্ছে আমাকে কি করতে হবে। যখনই আমার অল বডি মেয়ের সাজ নিয়েছে তখন কিন্তু আমি একজন নারী। তখন একজন নারীর যে সম্মান আমারও সেই সম্মান। আমাকে মনে করতে হবে যে মনসা, বেহুলা যে একটা মেয়ে আমিও সেই মেয়ে, সেই বেহুলার ভিতর আমাকে ঢুকতে হবে (ছুকরি শেরেবুল ইসলাম ২০১৭)।


ছুকরি শেরেবুলের এই বয়ান থেকে পুরুষের নারী হওয়া’ বা ‘রূপান্তরের প্রক্রিয়া বিষয়ে আরও পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়। উদ্ধৃতি অনুসারে রূপান্তর প্রক্রিয়াটি শুরু হয় সাজ-পোশাকে, মেকাপ ও গেটাপের সাহায্যে পূর্ণাঙ্গ নারীর সাজ গ্রহণসূত্রে নারী-ভাব জাগ্রত করার মাধ্যমে। অর্থাৎ ছুকরির দেহ-অন্তঃপুরের লাস্য অথবা নারীভাবের সক্রিয়তা এক্ষেত্রে সাজ-পোশাকের শর্তাধীন হয়ে পড়ে। শেরেবুলের মেকাপ গ্রহণ থেকে ছুকরি হওয়ার এই পুরো প্রক্রিয়ার নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা যায় ‘লিঙ্গের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা বিবেচনায় শেরেবুলের কাছে নারী’ হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কিছু ‘আচরণ’ বা ‘ক্রিয়া’ (অ্যাক্ট) (Butler 1990), যা তাকে প্রতি রাতের আসর থেকে আসরে অল বডি মেয়ের সাজে পুনঃপুনঃ নির্মাণ-বিনির্মাণের সূত্রে পরিবেশন করতে হয়। এক্ষেত্রে নারী’ রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ও প্রায়োগিক উপাদান বা টেক্সট তাঁরই সমাজ-পরিমণ্ডলে প্রতিকায়িত নারীর ঔচিত্য বা। অনুচিত্যমূলক আচরণ, চলন, বলন, স্বরধ্বনী, ভাবাবেগ ও প্রচলিত গল্প-কথন থেকে বাছাই ও বিন্যাসসূত্রে গ্রহণ করা হয়। এভাবেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার একটি নমনীয় তথা অনানুষ্ঠানিক পরম্পরাগত সামাজিক শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় একজন পুরুষ’ কুশীলব তাঁর মনো-দৈহিক শরীরে ছুকরির বীজ বপন করতে সক্ষম হয়।

ছন্দ ও তালে ছুকরি নৃত্য পরিবেশনার কৌশল।
ছুকরি নৃত্য পরিবেশনা।

নৃত্যশৈলী ও কাঠামো

পদ্মার নাচন ও বেহুলার নাচাড়ি’তে ছুকরি নৃত্যের কাঠামোটি ইতিবৃত্ত (প্লট) নির্দেশিত ঘটনাক্রম অনুসারে বিন্যস্ত- অর্থাৎ, কাহিনীর যে অংশে নৃত্য পরিবেশিত হয় তা পূর্ব নির্ধারিত। সাধারণত ৫ থেকে ৭ জন ছুকরির একটি দল নৃত্যে অংশগ্রহণ করে এবং আসরে এদের অবস্থান থাকে বৃত্তাবদ্ধ। দলের অভিজ্ঞ বা মেইন ছুকরির নেতৃত্বে এঁরা দলগতভাবে আসরের কেন্দ্রীয়-বৃত্তে অবস্থান করেন এবং ঘুরে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করেন। আসর অবস্থানের ক্ষেত্রে ছুকরিদের পছন্দ থাকে উন্মুক্ত, অবাধ, অনির্ধারিত। এক্ষেত্রে মেইন ছুকরি বৃত্তের অগ্রে থেকে নৃত্যের যে। সকল ঢং বা আইটেম প্রদর্শন করেন, তাঁর পশ্চাতে থাকা ছুকরিগণ সুদক্ষ অনুসরণ আর তাৎক্ষণিক সমন্বয়ের মাধ্যমে সেই সকল ঢং বা আইটেমের উৎকর্ষ প্রদর্শন। করেন। ফলে একটি অবাধ, উন্মুক্ত ও নমনীয় বিন্যাস ব্যবস্থার মধ্যেই প্রদর্শিত হয়। ছুকরিদের পেশাগত নৃত্যের নৈপুণ্য।

ছুকরি-১ : দলের মেইন ছুকরির চোখ থাকে বাজনার দিকে আর আমাগো চোখ থাকে মেইন ছুকরির দিকে। (ছুকরি হামেদ আলী ২০১৭)।

ছুকরি-২ : আমাদের বাজনা আছে, বাজনাডা যে দিকে যে দিকে যাইব, আমাদের নাচও সেদিকে সেদিকে যাইবো। (ছুকরি বারেক আলী ২০১৭)।

ওস্তাদ-৩: পদ্মার নাচনে ৬/৭ ঢং-এর নাচ আছে। গানের তালের সাথে মিল কইরা নাচের ঢং গুলা করা হয়। (শলোক ২০১৭)।

ছুকরি-৪: একজন তবলা বাদক যেভাবে শিল্পীর গানের সুর শুনেই বুঝতে পারেন যে কোন তালে বাজাতে হবে, আমরাও তাল শুনে বুঝতে পারি ঠিক কখন ও কি কি ঢং–এর নাচ নাচতে হবে। (ছুকরি শেরেবুল ইসলাম ২০১৭)।


উদ্ধৃত ৪টি উক্তি থেকে পদ্মার নাচন এবং বেহুলার নাচাড়ির ছুকরি নৃত্যের বৈশিষ্ট্য ও বিন্যাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উভয় দলের দেহ-বিন্যাসের মূলভিত্তি হলো তাল। তাই দুটো দলেরই তাল পূর্বনির্ধারিত থাকে। ফলে নৃত্যের (ঢং/আইটেম)। শৈলীগুলোও হয় নির্দিষ্ট। এই যুক্তিতে পদ্মার নাচনে চারটি তাল ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এছাড়া চারটি তালের সাথে সুরের সমন্বয়ে সৃষ্ট নৃত্যের দেহভঙ্গি ও চলনের বৈশিষ্ট্য অনুসারে আরও তিনটি, অর্থাৎ মোট ৭টি স্বতন্ত্র ঢং বা আইটেম চিহ্নিত করা যায়। এই ৭টি ঢং-এর নৃত্যের নামকরণও করা হয়ে থাকে তালের ছন্দ, গতি এবং ভঙ্গির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। যেমন-

ঢং- ১. তাত, তা তা ধিনা, নাক, তা, না ধিনা, (তাল- ভিন্ন কাহারবা)। দলের ব্যাখ্যা অনুসারে এটির মাত্রা বিভাজন কাহারবা তালের সাথে সাদৃশ্য থাকলেও আবর্তন সর্বদাই কাহারবা অনুরূপ থাকে না। তাই এই তালকে তারা ভিন্ন কাহারবা বলে থাকেন।

ঢং- ২. ধা তিন তা না কে ধিনা, তাই কিতা নাক ধিনা (তাল- দাদরা/ঝুমুর) এটি ধীর লয়ে দাদরা তাল এবং দ্রুত লয়ে ঝুমুর তাল-এ রূপান্তরিত হয়।

ঢং- ৩. ধিন তেতে নাকে ধিন (তাল- কাহারবা) এটি শুদ্ধ কাহারবা।

ঢং- ৪. ঘুণ্টি নাচ, (বৃত্তাকার নাচ) তাল কাহারবা হলেও শরীরের ঘূর্ণন বা চক্কর। থেকে এর নাম ঘুণ্টি নাচ।

ঢং- ৫. ষাট নাচ (পৃথক করা নাচ) এই নাচে দুই পায়ের চলনে দূরত্ব বজায় রাখা হয়।

ঢং- ৬. খোঁজ পয়ার- একই সুরের লয় ও তাল পরিবর্তন করে ক্রমাগতভাবে নৃত্যের ঢং-এ পরিবর্তন করা এবং

ঢং- ৭, টাকুর ঘুঁটা, টাকুর ঘুঁটা, এটি কোমর ঘোরানো/দোলানো নাচ।

ছুকরি নৃত্যের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এর চলন ও সঞ্চলনে পদ-যুগল সৃষ্ট গতিছন্দই হচ্ছে মূল এবং এর সাধারণ প্রবণতা বা ঝোঁক হচ্ছে ভূমি-অনুবর্তী থাকা। হস্ত-যুগলের লাস্যময় ভঙ্গি ও ভাষা এক্ষেত্রে পদ-যুগল সৃষ্ট গতি ও ছন্দের সুললিত ভারসাম্য রক্ষা করে মাত্র। তালের মাত্রা এবং ছন্দ অনুসারে বিন্যস্ত ভূমি-অনুবর্তী। পদক্ষেপণ, চলন, উল্লম্ফন, ঘূর্ণন প্রভৃতি নানা উপায়ে দেহের লাস্যময় ভাব-ভঙ্গির প্রদর্শনের মাধ্যমে কুশীলবের ব্যক্ত মুখের ভাষাকে ছাপিয়ে ভাষার অধিক ভাবজগতে ঝংকার তোলাতেই যেন এই নৃত্যের বিশেষত্ব হয়ে ওঠে।

অপরদিকে বেহুলার লাচারির নৃত্যে দেহভঙ্গি, চলন ও সঞ্চলন পদ্ধতিও তাল ও সুর অনুসারে বিন্যস্ত এবং তিনটি নির্ধারিত তাল, যেমন- দাদরা/ঝুমুর (৬ মাত্রা), তেওরা (৭মাত্রা) এবং খোলাবাড়ির (কাহারবা সদৃশ) প্রয়োগ দেখা যায়। তবে এই নৃত্যের আইটেমগুলোর নামকরণ করা হয় গানের বিষয় ও ভাব অনুসারে- নাচ নামে। অর্থাৎ পদ্মা-চান্দ দ্বন্দ্বের নাচ, বাণিজ্য গমনে মাঝিদের নাচ, চৌদ্দ ডিঙ্গা ডোবানোর নাচ, চান্দের প্রহরী হাতে নিগৃহ হওয়ার নাচ, লখিন্দরের জন্ম নাচ প্রভৃতি। পদ্মার নাচন থেকে বেহুলার নাচাড়ির নৃত্যে মৌলিক বৈসাদৃশ্য হচ্ছে, এই নৃত্য পদ-যুগলে নয় বরং হস্ত-যুগলের সৃষ্ট নানা প্রতীকী ভাষায় দেহভঙ্গি, চলন ও সঞ্চলন তরান্বিত করে। এক্ষেত্রে ছুকরির আঙ্গুলে বাঁধা একটি রুমাল গানের অর্থ ও ভাবানুসারে প্রতীকী বর্ণনায় প্রদর্শিত হয়। যেমন- মাথার উপর রুমালটি উল্লম্বভাবে রেখে ছাতি’ ধরা বা ঘাড়ের ওপর রেখে ‘মাটির পাত্র রাখা, অথবা প্রলম্বিত হাতে ‘ছিপ দিয়ে। মাছ ধরা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়।নাচে কখন কি কি করতে হবে তা গানের উপরেই হয়, কখন কোমর নাচতে হয়, কখন হাত দুলাইতে হয় ওডাতো গানের পয়ারে বইল্লা যাইতেছে, ওইডার সাথে আইসা যায় গা’ (নাজিমুদ্দিন ২০১৭)। আর এভাবেই বেহুলার লাচারির ছুকরি নৃত্য কুশীলব বর্ণিত মুখের ভাষা ও গল্পের অনুগামী দেহ-ভাষার প্রতীকী অলংকারে পরিণত হয়।

সামগ্রিক পর্যালোচনার উপসংহারে একথা বলাই যায় যে, ছুকরি নৃত্য সামাজিক সাংস্কৃতিক কৃত্য, আচার-অনুষ্ঠান এবং বিনোদনের প্রথাগত অনুষঙ্গ হিসেবে লোকায়তনে সমষ্টির শিল্প-মননে বিশিষ্ট ‘শৈলী’ রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে তাতে সন্দেহ নাই। এর মূলে রয়েছে সেই পরিবেশনা জ্ঞান যা পরম্পরাগতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে সমষ্টির সৃজন ভাবনায়- কুশীলবে দেহ-অন্তঃপুরের শৌর্যের অদ্বৈতরূপে, ভাবদেহ এবং দেহ-ভাবের অভেদাত্মক রূপ কল্পনায় অথবা সমাজে নারী’ ও ‘লিঙ্গের নির্মাণ-বিনির্মাণ ও প্রদর্শন ভাবনায়। বস্তুত নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত এসকল জ্ঞানই যুগ যুগ ধরে বাংলার ছোকরাদের সাহসী করেছে ছুকরির সাজে আসর মাঝে ভক্তের/দর্শকের হৃদয় দখল করতে ।


Saidur Rahman Lipon

লেখক পরিচিতি

ড. সাইদুর রহমান লিপন
লেখক ও গবেষক


সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী:
১. Angel, Marti. 2018. ‘Two Energies, One Body – Balance Your Male – Female Sides’ SelfGrowth.com. April 24, 2008. Accessed January 10, 2018
২. Butler, Judith. 1990. Gender Trouble. New York: Routledge
৩. Schechner, Richard. Performance Studies; An introduction. New York: Routledge, 2002
৪. Sahai, Shrinkhla. 2011. ‘Reading Dance, Performing Research.’ In Traversing Tradition; Celebrating Dance in India, by Urmimala Sarkar Munsi and Stephanie Burridge, 109. New Delhi: Routledge
৫. নাজিমুদ্দিন ওস্তাদ- ছুকরি নৃত্য, বেহুলার নাচারী সাক্ষাৎকার, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা: সাক্ষাৎকার গ্রহণ সাইদুর রহমান লিপন, নভেম্বর, ২০১৭
৬. ফরহাদ, মজহার–২০০৯, ‘বাংলার ভাবান্দোলন’, বাংলার ধর্ম ও দর্শন, সম্পাদনা রায়হান রাইন, ঢাকা: সংবেদ
৭. মুহাম্মদ এনামুল, হক- ২০০৯, ‘বঙ্গে লৌকিক ইসলাম-এর উদ্ভব’ বাংলার ধর্ম ও দর্শন, সম্পাদনা রায়হান রাইন, ঢাকা: সংবেদ
৮. মাসুদুজ্জামান, এবং হোসাইন সেলিনা, ২০০৬. জেন্ডার বিশ্বকোষ। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব জেন্ডার), ভোল– ১, ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স
৯. ছুকরি বারেক আলী, ছুকরি নৃত্য, বেহুলার নাচারী, সাক্ষাৎকার, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা: সাক্ষাৎকার গ্রহণ সাইদুর রহমান লিপন, নভেম্বর, ২০১৭
১০. ছুকরি হামেদ আলী– ছুকরি নৃত্য, বেহুলার নাচারী– সাক্ষাৎকার, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা: সাক্ষাৎকার গ্রহণ সাইদুর রহমান লিপন, নভেম্বর, ২০১৭
১১. শেরেবুল ইসলাম, ছুকরি নৃত্য, পদ্মারনাচন, সাক্ষাৎকার, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা: সাক্ষাৎকার গ্রহণ সাইদুর রহমান লিপন, নভেম্বর, ২০১৭
১২. ছুকরি হেলাল খান, ছুকরি নৃত্য, বেহুলার নাচারী, সাক্ষাৎকার, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা: সাক্ষাৎকার গ্রহণ সাইদুর রহমান লিপন, নভেম্বর, ২০১৭
১৩. জুহাস মিঞা, ছুকরি নৃত্য, বেহুলার নাচারী, সাক্ষাৎকার, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা: সাক্ষাৎকার গ্রহণ সাইদুর রহমান লিপন, নভেম্বর, ২০১৭
১৪. ওস্তাদ রেজাউল হক শলোক– ছুকরি নৃত্য, পদ্মারানাচন, সাক্ষাৎকার, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা: সাক্ষাঙ্কার গ্রহণ সাইদুর রহমান লিপন, নভেম্বর, ২০১৭
১৫. শরীফ আহমদ– ‘বাংলার সুফী সাধনা’ বাংলার ধর্ম ও দর্শন, সম্পা, রায়হান রাইন, ঢাকা: সংবেদ ২০০৯
১৬. শরীফ আহমদ, ‘চৈতন্য মতবাদ ও ইসলাম’, বাংলার ধর্ম ও দর্শন, সম্পা রায়হান রাইন, ঢাকা: সংবেদ ২০০৯
১৭. রায়হান, রাইন, ২০০৯, ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে ভক্তিবাদ’, বাংলার ধর্ম ও দর্শন, সম্পাদনা রায়হান রাইন, ঢাকা: সংবেদ


More Publications