ভাটিয়ালি গান ও ভাটি বাংলার জীবন দর্শন

বাংলার প্রত্যন্ত নিম্নাঞ্চল বা ভাটি অঞ্চলটিতে আমার জন্ম। সময়টা ৮০-এর দশক। যখন একটু বুঝতে শিখলাম, গ্রাম জুড়ে ছুটোছুটি করতাম, তখন দেখতে পেতাম বছরের ভিন্ন ভিন্ন মাসে আমাদের চারিদিকের প্রকৃতির রূপটাও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে উঠতো। বসন্তের আগমনী হাওয়া যখন উষ্ণতা ছড়িয়ে গায়ে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়, তখন গ্রাম জুড়ে এক জিজ্ঞাসার রব উঠে- এবছর খরা বেশি হবে নাকি কম হবে, সামনেই যে চৈত্র মাস। ভাটি অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় খোরাক ধান চাষ। নিম্নভূমি তাই এক ফসলের ফলনের উপরই নির্ভর করে বছরটি কেমন যাবে। বৈশাখ মাস গড়িয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে গাঙ্গে নয়া পানির আগমন শুরু হয়, আষাঢ় মাসে নয়া পানির গন্ধে এক অন্যরকম ব্যাকুলতা নিয়ে আসে গ্রামীণ জনপদে। যে নদী চৈত্র মাসে চর পড়ে সেই নদীই তখন গ্রাম বাংলায় এক নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। ডিঙি নৌকা, পাল তোলা নৌকা, গুণটানা নৌকা, বড় বড় মহাজনী নৌকাগুলো ভেসে বেড়াতে শুরু করে। কিছু কিছু মহাজনী নৌকা আসে দূরদেশ থেকে ধানের বুঝাই নিয়ে। কিছু কিছু দাঁড়টানা খোলা নৌকা খড়ের বুঝাই দিয়ে বয়ে চলে নয়া পানির স্রোতে হাল ধরা মাঝির বৈঠা অনুসরণ করে। এই সময়টায় ভাটি বাংলায় প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। গোলায় গোলায় ধানের মজুত করা, খড় দিয়ে পিরামিড আকৃতির বনের লাছ করা, সবজি খেত থেকে ফসলগুলো তোলা, দূরগ্রাম হতে ফসলী জমির খড় কেটে নৌকা বুঝাই করে নিয়ে যাওয়া, এইগুলো বর্ষার পানি কানায় কানায় ভরে উঠার পূর্ব মুহূর্তের চিত্রপট। বর্ষার আগমন ঘটতেই, গৃহবধূ অপেক্ষায় থাকে বাপের বাড়ি থেকে ভাই আসবে নতুন ফসলের খবর নিয়ে, বর্ষার জল ফুলে উঠলে বোনকে নাইওর নিয়ে যাবে। এমন জনজীবন আর প্রকৃতির মাঝেই আমার শৈশব কেটেছে ।

ভাটিয়ালি গান ও ভাটি বাংলার জীবন দর্শন

ছোটবেলা থেকে যতটুকু সুর, সংগীত, তথা প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ভালবাসতে শিখেছি তা বাবার হাত ধরেই। বর্ষাকালে ঝমঝম বৃষ্টিতে সন্ধ্যে নামার আগেই অন্ধকার নেমে আসে গ্রামবাংলায়। সন্ধ্যা আরতিকালে আমরা সবাই জড়ো হতাম আমাদের কাঠের দোতলা ঠাকুরঘরের গানের আসরে। তেমনই এক বর্ষার সন্ধ্যা, টিনের ছাদে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ, সবাই যেন উদাসী হয়ে উঠলো, বাবা ধরলেন একটি ভাটিয়ালি গান। বাবার সাথে সাথে আমরাও ধরলাম,

মাঝি বাইয়া যাওরে, অকূল দরিয়ার মাঝে
আমার ভাঙ্গা নাও রে।।
শিমুল কাঠের নৌকাখানি, মাঝখানে তার ছইয়া,
(নাইয়ের) আগের মাঝি পাছায় গেলে
গলই যায়গা খইয়া।।

বর্ষাকালে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরেই বসে গানের আসর। নানান কথায়-গল্পে-গানে সবাই অন্তরের ভাব আর ব্যাকুলতার প্রকাশ করে। গানের আবেগে অশ্রুসিক্ত নয়নে মন হালকা হয়ে যায়। গৃহিণীরা দুইহাতে চোখ মুছতে মুছতে অপার আনন্দ অনুভব করে রাতের খাবার রান্না শেষ করেন। কুপির নিভু নিভু আলোয় সবার জন্যে থালা বেড়ে নিয়ে আসেন গরম ভাত,কাঁচা পেঁয়াজ-মরিচের সাথে আলুভাজি, পাতলা ডাল আর ছোটমাছের চচ্চড়ি। এটাই ভাটি বাংলার সহজ সরল সাধারণ মানুষের জীবনের চিত্রপট।

আমার বাবা-জ্যেঠুরা যে বাড়িটিতে জন্মগ্রহণ করেন সেটি ছিল নদী তীরবর্তী। যেখানে বর্ষাকালে খরস্রোতা নদীর ঢেউয়ের তাণ্ডবে প্রাণ কেঁপে উঠতো, আবার স্নিগ্ধ বিকেলে মৃদু বাতাসে পাল তোলা নৌকার মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শোনা যেত। ১৯৪৭-এর সাম্প্রদায়িক দেশভাগের সময় বাবা-জ্যেঠুরা পারস্পরিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু নাড়ির টান, ভাটির টান, ভাটিয়ালি গানের সুর থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন হতে পারেন নি, বরং সে টান অনুভব করেছেন প্রতিনিয়ত। সময়ের স্রোতে যুগের পর যুগ যখন ভাইয়ে ভাইয়ে দেখা হয় না, তখন বাবার বড়ভাই সীমান্তের অপর প্রান্ত থেকে রেডিওতে একটি গান শুনে অঝোরধারায় কাঁদতেন । গানটি ছিল “কে যাসরে ভাটির গাঙ বাইয়া” এই গানটি যার কণ্ঠে হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠে প্রতিটি দেশপ্রেমী মানুষের কাছে, তিনিও এমনই দেশত্যাগী একজন মানুষ কিংবদন্তী শিল্পী শচীন দেব বর্মণ। গানের
কথাগুলো এমন:

কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া
আমার ভাইধন রে কইও নাইওর নিতো বইলা
তোরা কে যাস কে যাস।
বছর খানি ঘুইরা গেল গেল রে ভাইয়ের দেখা পাইলাম না পাইলাম না
কইলজা আমার পুইড়া গেল গেল রে
ভাইয়ের দেখা পাইলাম না পাইলাম না
ছিলাম রে কত আশা লইয়া
ভাই না আইলো গেল গেল রথের মেলা চইলা
তোরা কে যাস কে যাস।

আমার জন্মস্থানের জীবন চিত্রপটে, জনমনের ভাবনার সাথে ভাটিয়ালি গানের যে সংযাোগ, তারই কথা নাগরিক সমাজকে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত গণসংগীত ও লোকসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস উনার “লোকসঙ্গীত সমীক্ষা : বাংলা ও আসাম ” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন “ভাটীয়ালী যখন গাই মনের পর্দায় সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে সেই মানুষ ও প্রকৃতির ছবির সারি। কিন্তু সেই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নাগরিক শ্রোতার মনের পর্দায় কি সে ছবি প্রক্ষিপ্ত হয় ? ভাটীয়ালীর সুজন নাইয়াকে হয়ত তাঁরা কোনদিন দেখেছেন দূরে কোন পালের আড়ালে-চলন্ত ট্রেনের ক্যামেরা থেকে রোমান্টিক চোখে। কিন্তু ভাটীয়ালীর বিলম্বিত রেশের সুজন নাইয়াকে কি এই চোখে চিনতে পারা যায় ? ঝড়োদিনে বর্ষার হাওরে পাগলা ঢেউএর সওয়াব সুজনকে কি তাঁরা দেখেছেন ? কড়া হাতে বাঘথাবা মুঠোয় হালের হাতল ধবে শঙ্খচিলের মতো ঝড় কাটিয়ে যাওয়া সুজনকে
দেখলে, নৌকাবাইচে মরণপণ পাল্লায় দলবদ্ধ হুল্লোড়ে সারিগানের ছান্দসিক সুজনকে না দেখলে, নিস্তরঙ্গ ভাটীগাঙে কর্মবিরত সুজনের লিলুয়া বাতাসে ভাটীয়ালীর ভাবালুতাকে কি করে উপলব্ধি করবেন?”

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের নিম্ন ও সমতল ভূমি হাওর বাওরে ঘেরা বিস্তীর্ণ জলরাশিতে পরিপূর্ণ অঞ্চলটি – ‘ভাটি বাংলা বা ভাটি অঞ্চল’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের মানচিত্রের ভৌগোলিক অবস্থানে ৭ টি জেলা যথাক্রমে হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রায় ৪০টি উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত ভাটি অঞ্চল। ভাটি অঞ্চলগুলোতে সারা বছরে মূলত: দুইটি ঋতু আসে, একটি বর্ষাকাল আর একটি হেমন্তকাল। এই অঞ্চলগুলো প্রায় ছয়মাস পানিবেষ্টিত আর ছয়মাস শুকনো মৌসুম। হাওর-বাওরে, নদী বেষ্টিত ভাটি অঞ্চলগুলোতে যখন বর্ষার পানি ঢুকে পড়ে তখন বুঝার উপায় থাকে না কোথায় নদী আর কোথায় জমি, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । এক একটি গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এক একটি দ্বীপের মত। গ্রাম্যজনপদে নেমে আসে অলস সময়। আর একমাত্র চলাচলের মাধ্যম হয় শুধু ছোট বড় হরেক রকমের নৌকা । প্রকৃতি নির্ভর মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহের সাথে নিত্যদিনের সঙ্গী হয় নদী, জল, নৌকা আর ভাটিয়ালির সুর। নদীমাতৃক বাংলার ভাটিয়ালি গান যে শুধুই ভাটি অঞ্চলের গান তা নয়। অনেকেই এমনটি বলেন, ভাটি অঞ্চলই ভাটিয়ালি গানের মূল উৎস হলেও তার পরিপূর্ণতা লাভ করেছে নাকি যমুনা এবং মেঘনা নদীর উপত্যকায়। তাছাড়া পদ্মা নদীর উপত্যকায়ও জন্ম হয়েছে অনেক ভাটিয়ালি গানের। তবে ফরিদপুর, খুলনা এবং বরিশালকে অনেকেই ভাটি অঞ্চল বলে মনে করেন।

ভাটিয়ালি’ নামের শব্দগত ও অর্থগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভাটি শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ভাটার দিকে, স্রোতের অনুকূলে বা নিম্নদিকে ( উজানের বিপরীতে)। অন্যদিকে ভাটিয়ালি সঙ্গীত শাস্ত্রের একটি রাগিণী, যার ব্যবহার শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-বৈষ্ণবপদাবলী, মঙ্গলকাব্যেও পরিলক্ষিত হয়। আবার বলা হয় বিশেষেত: ভাটার স্রোতে নৌকা ভাসাইয়া দিয়া যে রাগিণীতে গান গাওয়া হয় তাই ভাটিয়ালি। ভাটিয়ালি গান মূলত ধীর লয়ে, সুরকে লম্বা মাত্রায় টেনে টেনে অলস শান্ত উদাস মনের ভাবধর্মী গান। বিষয়গতদিক থেকে ভাটিয়ালি গান মূলত তিন ধরনের তা হল- লৌকিক প্রেম, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এবং আধ্যাত্মিকতা। ঠিক কবে লৌকিক প্রেমের ভাটিয়ালি গানের জন্ম তা বলা মুশকিল। তবে নদীমাতৃক বাংলার ভাটি অঞ্চলের আদিলগ্ন থেকেই রাজা, জমিদার, সওদাগরেরা নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যে দূরযাত্রার একমাত্র মাধ্যম ছিল নানা মাপের ও ঢঙের পাল তোলা বা গুণটানা নৌকা। দিগন্তব্যাপী জলরাশিতে তালবিহীন সুরে ও ভাব বৈচিত্র্যে যে প্রেম-সংগীত, বিচ্ছেদী-সংগীত, বাউলদের ভাষায় প্রকৃতিতত্ত্ব (নদী, নাইয়া, নৌকা) বা দেহতত্ত্বের গান সৃষ্টি হত সেগুলোই ভাটিয়ালি গান। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত আশুতোষ ভট্টাচার্য্য উনার “বাংলার লোক সাহিত্য” গ্রন্থে বলেন “বাংলার প্রেম-সঙ্গীত প্রধানত ভাটিয়ালি সঙ্গীত৷ যে সঙ্গীতের কোন তাল নাই, তাহাই ভাটিয়ালি সঙ্গীত বলিয়া পরিচিত। অলস বা নিষ্ক্রিয় অবসরের সময়ই প্রধানত বাংলা প্রেম-সঙ্গীত গীত হয়, ইহা প্রায়ই কোন কর্ম্মের সহচর নহে বলিয়া ইহাতে কোনও তাল সৃষ্টি হইতে পারে না”।

ভাটিয়ালি গান ও ভাটি বাংলার জীবন দর্শন

মাঝি-মাল্লা ও সাধারণ মানুষের এইসব ভাবগীতি যুগে যুগে আমাদের লোককবি, চারণকবি, গীতিকবি, সংগ্রাহক, লোকশিল্পীদেরও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই তাঁরা রচনা করেছেন, সংগ্রহ করেছেন, নিজের কণ্ঠে ধারণ করে বয়ে বেড়িয়েছেন ভাটিয়ালি সঙ্গীতের সুর৷ তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি নিবারণ পন্ডিত, গিরীন চক্রবর্তী, তুলসী লাহিড়ী, পল্লীকবি জসিমউদ্দিন, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মিরাজ আলী, কানাইলাল শীল, মনমোহন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, উকিল মুন্সী, আবদুল ওয়াহেদ, রশিদ উদ্দিন , জালাল খাঁ , ফেলু শেখ, জং বাহাদুর, শচীন দেব বর্মণ, আব্দুল আলিম, আব্বাস উদ্দিন, শাহ আবদুল করিম, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, কিরণচন্দ্র রায়, আরিফ দেওয়ান, উমেদ আলী, উৎপলেন্দু চৌধুরী, রথীন্দ্রনাথ রায়, ফেরদৌসী রহমান, মুস্তফা জামান আব্বাসী প্রমুখ। তাছাড়াও অনেক ভাটিয়ালি গান লোক মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে দিগদিগন্তে । যুগ যুগ ধরে গীত হচ্ছে, কারো জানা নেই সেসব গানের গীতিকার বা সুরকার কে?

ভাসান পানির আগমনে গ্রাম্যজীবনের মধ্যে এক চঞ্চলতা জেগে উঠে । বাংলাদেশের নেত্রকোনার লোককবি উকিল মুন্সি ভাটিয়ালি গান রচনা করেন। এইসব ভাটিয়ালি গানে প্রকৃতিতত্ত্বের সাথে আধ্যাত্মিকভাবের এক মিলন লক্ষ্য করা যায়। কার্তিক মাসের ভাসান পানিতে গ্রাম্য বধূর বাপের বাড়িতে নাইওর যাবার আকুলতা, আবার জীবনের অন্তিমযাত্রা পথিকের নাইওর (মৃত্যুর) যাবার এক ভাবাবেগের কথাও ফুটে উঠেছে এই ভাটিয়ালি গানটিতে–

আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে, পুবালী বাতাসে
বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি আমার নি কেউ আসে রে।
গাঙে দিয়া যায় রে কত, নায় নাইওরির নৌকা
মায়ে ঝিয়ে বইনে বইনে, হইতেছে যে দেখা রে।।
ভাগ্য যাহার ভালরে নাইওর যাইবে আষাঢ় মাসে
উকিলেরই হইবে নাইওর, কার্তিক মাসের শেষে রে।।

ভাটিবাংলা সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হল মনসামঙ্গল কাব্য। সেই কাব্যের বেহুলা লক্ষীন্দরের হৃদয়স্পর্শী গল্পকথায় জন্ম হয়েছে অনেক গান, পুঁথি ও রূপকথার। ভাটিয়ালি গানের সুরেও ঠাঁই পেয়েছে বেহুলা লক্ষীন্দরের গল্প কথা। এমনি একটি ভাটিয়ালি গান হল:

বেহুলা মান্দাসে ভাসে মরা পতি লইয়া
মনসার রোষানলে সিঁদুর যায় মুছিয়া।
পুণ্যবতী মহাসতী বেহুলা অভাগিনী
জীবন দিয়ে বাঁচায় যে সে পতির জীবনখানি
ইন্দ্র সভায় হেসে চলে আশায় বুক পাতিয়া।

ভাটিয়ালি গান যে শুধু ভাটি অঞ্চল জুড়েই বিস্তৃত তেমনটি নয়। নদীমাতৃক বাংলার যেথায় নদ-নদী প্রবাহমান, যেথায় পাল তোলা নৌকায় মাঝি বৈঠার হাল ধরে মাঝ-দরিয়ায় ভেসে চলেছে, সেথায়ই জন্ম নিয়েছে ভাটিয়ালি গান। পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের মাঝেও ভাটিয়ালি গান সাহস যোগায় মাঝি-মাল্লাদের। ঘন বর্ষার তীব্র ঝড়-তুফানে মাঝি যখন মাঝ দরিয়ায় নৌকা সামাল দেয়, ভাটিয়ালি গান তাকে শক্তি যোগায়, সাবধান হওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়। ঝড়ের মাঝেও মাঝিকে বুক ফুলিয়ে ঝড়ের মোকাবেলা করার সাহস দেয়। এই কঠিনকে পার করে বিজয় ছিনিয়ে মাঝি ঠিক ফিরবে কিনারে এই আশাবাদের সাথে আধ্যাত্মিকভাবের এক বিশেষ সংযোগ যেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের এই ভাটিয়ালি গানটিতে দৃশ্যায়িত হয়েছে–

ও মাঝিরে – আজি ঝড় তুফানে চালাও তরী
হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হো।।
ওরে ঝড় আসে তো আসুক তোমার তুফানে কি ডর
ঝিলকি-ঠাডা সাথের সাথী পদ্মাতে যার ঘর, মাঝিরে।।
এখন তুফান দেইখা পরান নাচে ফুলছে নায়ের পাল
ও তুই ঝড়ের মতো গর্জিয়া ওঠ বক্ষে ঠুকি তাল, মাঝিরে।।
ওরে মেঘে আগুন দিয়ে নাচে কার পাগিলি মেয়ে
সে যে চির জয়ের পথ দেখায়ে চলছে আগে ধেয়ে, মাঝিরে।।

দূরদেশ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের পণ্যসামগ্রী নিয়ে কত শত পথ-ঘাট, বাজার-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ পেরিয়ে যেন নৌকা ভেসে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। সেই কবে ঘর ছেড়ে গঞ্জে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে ভালো মন্দের বাছবিচারের বেড়াজাল সামলে ঘরে ফিরছে ক্লান্ত মাঝি তার সওদাগরকে নিয়ে। মনের মাঝে বৈষয়িক হিসেব কষে কষে ক্লান্ত দেহ যখন নৌকার মাচাঙে শায়িত হয়, সাংসারিক ভাব চৈতন্য ছাপিয়ে অচেতন মনের ভাটিয়ালি সুর তখন রঙবেরঙের জীবনের ছটায় খুঁজে বেড়ায় অন্তরের সত্তাকে। কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় দেহতত্ত্বের সেই নিগূঢ় কথা–

দেহতরী দিলাম ছাড়িয়া
ও গুরু! তোমারও নামে
আমি যদি ডুবে মরি, কলঙ্ক তোমার নামে৷৷
বাজারিরা বাজার করে, কতো রঙের বাত্তি জ্বলে
গুরু, দোকানের সামনে;
তারা জ্বালাইয়া বাত্তি করে ডাকাতি সদর মোকামে।।
বাজার দেখে লাগে ধন্দ, বুঝি আমারি এ কপাল মন্দ
পইড়াছি ফেরে;
আমি নারায়ণগঞ্জ ছাইড়া আইলাম মদনগঞ্জের মোকামে।।
মদনগঞ্জে গেলে পরে, কামকুম্ভীরে ধরবোই তরে
পড়বিরে ফেরে;
আগে সিদ্ধিরগঞ্জ যাইয়া শেষে যাও নিত্যধামে।।

ঠিক যেন একিই আদলে আরো একটি ভাটিয়ালি গান রচনা করেন সুনামগঞ্জের কিংবদন্তি লোককবি বৈষ্ণব বাউল রাধারমণ দত্ত। প্রকৃতির সাথে আধ্যাত্মিকতার অপরূপ সুরের গানটি বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠে প্রখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর কণ্ঠে। আরো একটি বিশেষ ঘটনায় এই গানটি বিশেষ মর্যাদা পায়। ১৯৫৫ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু রাশিয়া সফরে গেছেন সাথে ওস্তাদ বেলায়েত খাঁন, সিতারাদেবীর মত ব্যক্তিত্বরা। এমনই এক সন্ধ্যায় মস্কোর বলশৈ থিয়েটারে মায়াবী আলোয় রাশিয়ান সোপ্রানোর গলা যখন স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করছে, এমন সময় ভারতীয় প্রতিনিধিদলের এক বাংগালী গায়ক মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। শুরু করলেন এক বাংলাগান, লোক সুরের মূর্ঘনায় ভেসে গেল গোটা অডিটরিয়াম। সেই বাঙালি গায়ক আর কেউ নন নির্মলেন্দু চৌধুরী। এরপর বহুদিন বাদে একদিন ওস্তাদ বিলায়েত খাঁনের মনে পড়েছে সেই গানের কথা। আহাকি সুর কি গলা, খোঁজ শুরু করলেন নির্মলেন্দু চৌধুরীর। কিন্তু ততদিনে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, কিন্তু গানটি ওস্তাদজীর চাই। তাই ডাক পড়লো ছেলে উৎপলেন্দু চৌধুরীর। দেখা হতেই ওস্তাদজী সেই গানের গল্প ও প্রতিনিধি দলের কথা বললেন। তারপর সেই গান শিখানোর আর্জি জানালেন। উৎপলেন্দু তো অবাক। বিশ্ববিখ্যাত সেতার বাদক ওস্তাদ বেলায়েত খাঁ তার কাছে একটি লোকগীতি শিখতে কলকাতায় এসেছেন। শেখালেন সেই গান। পরবর্তীকালে ওস্তাদজী সেই গান শুনিয়েছিলেন দর্শকদের। সেই গান তো শুধু গান ছিল না, ছিল নদীতে বৈঠা ধরা মাঝিদের এক লোকগাঁথা ভাটিয়ালির টান। আর এইভাবে নির্মলেন্দু চৌধুরী নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন মানুষকে, ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। সেই বিখ্যাত ভাটিয়ালি গানটি হল–

নাইয়ারে সুজন নাইয়া,
নাইয়া আমি নদীর কূল পাইলাম না।
কালো মেঘে সাঁঝ কইরাছে, পরান যে মানে না,
কিনারা ভিড়াইয়া বাইও ,নাও যেন ডুবে নারে। ও নাইয়ারে…
ঢাকার শহর রং বাজারে, রঙের বেচাকেনা,
মদনগঞ্জের মহাজন মোরা, ওই ঘাটে যাইও নারে৷ ওনাইয়ারে…
ভাইবে রাধারমণ বলে, এই পারে বসিয়ারে,
তুমি সকলেরে তরাইলায় গুরু, আমার দিন যে গেল গইয়া।

ভাটিয়ালি গান ও ভাটি বাংলার জীবন দর্শন

নদীবিধৌত গ্রামবাংলার হাওর বাওর যখন ভরপুর পানিতে টইটুম্বুর, তখন নদীতে বড় বড় মহাজনী নৌকার আগমন ঘটে। নৌকার গলই ধরে দাঁড়ের টানে নৌকা এগিয়ে চলে সামনে দিকে। উথালি পাথালি পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দের সাথে এক দারুন তালের সৃষ্টি হয়। সেই তাল ও ছন্দে আনমনা মাঝির ভাবাবেগের সাথে নদীর দুইধারের প্রকৃতির রূপ, ধানের শীষে বাতাসের দোল, শালিক পাখির ডানা মেলে উড়েচলায় বিমোহিত গীতিকবি গিরীন চক্রবর্তীর এই ভাটিয়ালি গানটি যেন তারই প্রতিচ্ছবি।

নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে
ছল ছলাইয়া চলুক রে নাও মাঝ দইরা দিয়া।।
আরে উড়ালি বিড়ালি বাওয়ে নাওয়ের বাদাম নড়ে
আথালি পাথালি পানি ছলাৎ ছলাৎ করে রে।
আরে খল খলাইয়া হাইসা ওঠে বৈঠার হাতল চাইয়া।।
ঢেউয়ের তালে পাওয়ের ফালে নাওয়ের গলই কাঁপে
চির চিরাইয়া নাওয়ের ছৈয়া রৌদ তুফান মাপে।
আরে চিরলি চিরলি ফুলে ভোমর ভোমরি খেলে রে
বাদল উদালী গায়ে পানিতে জমিতে হেলে রে
আরে তুর তুরাইয়া আইল দেওয়া ঝিলকি হাতে লইয়া।।

শালি ধানের শ্যামলা বনে হৈলদা পঙ্খি ডাকে
চিকমিকাইয়া হাসে রে চাঁদ, সরিষা ক্ষেতের ফাঁকে।
সোনালী রূপালী রঙ্গে রাঙ্গা হইল নদী
মিতালি পাতাইতাম মুই মনের মিতা পাইতাম যদি রে
আরে ঝিল মিলাইয়া ঝালর পানি নাচে থৈইয়া থৈইয়া

বাংলার আরেক কিংবদন্তি দোতারাবাদক, লোকগানের রচয়িতা ও সংগ্রাহক কানাইলাল শীল অনেক ভাটিয়ালি গানের রচনা করেন। ১৯৮৭ সালে লোক সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্যে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। অনেক লোকসংগীত পিপাসুরা ভাটিয়ালি গানের তালিম নিয়েছেন কানাইলাল শীলের কাছ থেকে। তাদের মধ্যে সুপরিচিত লোকসংগীত শিল্পী মুস্তফা জামান আব্বাসী অন্যতম৷ কানাইলাল শীল রচিত অত্যন্ত সুপরিচিত একটি বিচ্ছেদী অংগের ভাটিয়ালি গান হল–

তোমার লাগিয়া রে
সদাই প্রাণ আমার কান্দে বন্ধুরে
প্রাণ বন্ধু কালিয়া রে।।
নিদয় নিঠুর রে বন্ধু, তুই তো কূল নাশা,
(আমায়) ফাঁকি দিয়ে ফেলে গেলি রে বন্ধু।
না পুরাইলি আশা বন্ধু রে।।
আগে যদি জানতাম রে বন্ধু, করবাই রে নৈরাশা,
(ও তুই) না জেনে পীরিতের রীতি রে বন্ধু।
ঘটাইলি দুর্দশা বন্ধু রে।।
হৃদয় চিরিয়া রে দিতাম হৃদয়তে বাসা,
(আমি) তেমায় দেখে সাধ মিটাইতাম রে বন্ধু।
খেলতাম প্রেমের পাশা রে বন্ধু ।।

আজ গ্রামবাংলার ভাটিয়ালি গান দেশের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে দরবারে। অপরদিকে, কতশত ভাটিয়ালি গান বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পৃষ্টপোষনের অভাবে, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অভাবে। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে লোকগানের ভাণ্ডার তথা ভাটিয়ালি গানের যে মণিমুক্তা লুকিয়ে আছে তার সন্ধান করা এবং সেইসব গানগুলোর চর্চা করা খুব জরুরি। প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী মুস্তফা জামান আব্বাসী ভাটিয়ালি গানের সংরক্ষণ ও চর্চা প্রসংগে বলেছিলেন, বাংলার গ্রামে গ্রামে একটি গানের ঘর থাকবে, যে ঘরটির নাম হবে ভাটিয়ালি ঘর। গিদালরা এখানে নিয়মকরে আসবেন, দোতারা বাজনা শিখাবেন, লোকগান শিখাবেন। আজ আমাদের এমনই এক উদ্দ্যোগের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। তা না হলে গুটি কয়েক ভাটিয়ালি গান ছাড়া, আমরা আমাদের বিশাল ভান্ডারকে হারিয়ে ফেলবো। আমার এই ছোট্ট লিখনিতে, আমার স্বল্প জ্ঞানে স্বচক্ষে দেখা নিজ গ্রামের সামান্য অভিজ্ঞতার বর্ননা করার চেষ্টা করেছি মাত্র। বাংলার লোকসংস্কৃতির কয়েকজন দিকপাল ও কিংবদন্তি লোককবি, রচয়িতা, লোকশিল্পী,সংগ্রাহক ও গবেষক যাঁরা ভাটিয়ালি গানকে বিভিন্ন কর্মপন্থার মাধ্যমে আপামর জনসাধারণ তথা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন উনাদের নাম উচ্চারণ করার চেষ্টা করেছি। গুটি কয়েক গানের আংশিক ও তার ভাব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের লোকসংস্কৃতির কদর, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পৃষ্টপোষনে সবাইকে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।


লেখক পরিচিতি

গুরুপ্রসাদ হোম চৌধুরী
প্রবাসী সংস্কৃতিকর্মী


সূত্র:
১. “লোকসঙ্গীত সমীক্ষা : বাংলা ও আসাম” গ্রন্থ; হেমাঙ্গ বিশ্বাস।
২. “বাংলার লোক সাহিত্য” গ্রন্থ; আশুতোষ ভট্টাচার্য্য।
৩. “আমাদের ভাটিয়ালী”; কিশোরগঞ্জ ডট কম।
৪. “ভাটির গান ভাটিয়ালী গান” ; আমাদের নিকলী.কম, মহিবুর রহিম।
৫. “সারেগামা বেঙ্গলি” ; ক্যারাভ্যান ক্লাসিক রেডিও শো।
৬. “জাগোনিউজ২৪.কম”; ভাটিয়ালীর করুণ দর্শন তত্ত্ব৷
৭. “ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি” গ্রন্থ; মুস্তফা জামান আব্বাসী।


More Publications